শিমুল অধিকারী সুমন,চাঁদপুর: নদীর প্রবল ভাঙন আর প্রকৃতির সাথে লড়াই করে টিকে থাকা চাঁদপুরের হাইমচর উপজেলার ঐতিহ্যবাহী চরভৈরবী শ্রী শ্রী গৌর নিতাই আশ্রম এখন উৎসবের নগরীতে পরিণত হয়েছে। মেঘনা নদীর ভাঙন থেকে রক্ষা পাওয়া এই পবিত্র ভূমি আজ মুখরিত হাজারো ভক্তের পদচারণায়। ভক্তি, শ্রদ্ধা আর পরম করুণাময়ের নাম জপ করার মধ্য দিয়ে এখানে শুরু হয়েছে আশ্রমের ৪০তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী ও তারকব্রহ্ম নামযজ্ঞ মহোৎসব। চার দশক পূর্তির এই বিশেষ আয়োজনকে কেন্দ্র করে স্থানীয় হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মাঝে বইছে অভূতপূর্ব আনন্দের জোয়ার।
সনাতন ধর্মীয় রীতি মেনে গত ১৭ ডিসেম্বর, বুধবার সন্ধ্যায় শ্রীমৎ ভগবত পাঠের মাধ্যমে উৎসবের আনুষ্ঠানিক সূচনা হয়। এরপর তারকব্রহ্ম হরিনামযজ্ঞের শুভ অধিবাস কীর্তনের মধ্য দিয়ে পুরো এলাকায় এক আধ্যাত্মিক পরিবেশের সৃষ্টি হয়।
আজ ১৮ ডিসেম্বর, বৃহস্পতিবার ব্রহ্মমূহুর্তে ওঙ্কার ধ্বনি ও হরিনাম যজ্ঞের শুভারম্ভের মধ্য দিয়ে মূল পর্ব শুরু হয়েছে। আশ্রম প্রাঙ্গণে স্থাপিত সুসজ্জিত মন্দিরে চলছে দেবতার আরাধনা। আয়োজক কমিটির ঘোষণা অনুযায়ী, ১৯ ডিসেম্বর শুক্রবার এবং ২০ ডিসেম্বর শনিবার অহোরাত্র শ্রী শ্রী হরিনাম যজ্ঞের মহানাম ধ্বনিত হবে। আগামী ২১ ডিসেম্বর, রবিবার রাতে নাম যজ্ঞ সমাপন, বর্ণাঢ্য নগর পরিক্রমা এবং ঐতিহ্যবাহী জলকেলি উৎসবের মাধ্যমে এই পাঁচ দিনব্যাপী মহোৎসবের সমাপ্তি ঘটবে।
মহোৎসবের দ্বিতীয় দিন ১৮ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়,
মেঘনা তীরের এই জনপদ আজ এক মহামিলন মেলায় পরিণত হয়েছে। হাড়কাঁপানো শীত উপেক্ষা করে আশেপাশের বিভিন্ন গ্রাম এবং দূর-দূরান্ত থেকে হাজার হাজার ভক্তের সমাগমে তিল ধারণের ঠাঁই নেই মন্দির প্রাঙ্গণে। উলুধ্বনি, শঙ্খের আওয়াজ আর খোল-করতালের শব্দে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হচ্ছে।
নামযজ্ঞ শ্রবণ করতে আসা ভক্ত প্রতাপ ও অমল জানান, “মেঘনার করাল গ্রাস থেকে রক্ষা পাওয়া এই আশ্রমে আসতে পেরে আমরা ধন্য। হরিনাম সংকীর্তন শুনলে মনের অস্থিরতা দূর হয় এবং এক ধরনের স্বর্গীয় প্রশান্তি অনুভূত হয়।” মিনতি ও নিধু বনিক আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বলেন, “এই তারকব্রহ্ম নামযজ্ঞ আমাদের আধ্যাত্মিক চেতনা বৃদ্ধি করে। আমরা প্রতি বছর এই দিনটির জন্য অপেক্ষা করি।”
প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষে আশ্রমে বিশাল পরিসরে মহাপ্রসাদ বিতরণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রতিদিন হাজার হাজার ভক্তের মাঝে অন্ন প্রসাদ বিতরণ করা হচ্ছে। আশ্রম চত্বরে পাশে নোয়া বাড়িতে সুশৃঙ্খলভাবে প্রসাদ গ্রহণের জন্য বড় আকারের প্যান্ডেল নির্মাণ করা হয়েছে। স্বেচ্ছাসেবক দলের সদস্যরা নিরলসভাবে আগত অতিথিদের সেবা প্রদান করছেন। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল স্তরের মানুষের জন্য এই মহাপ্রসাদের দ্বার উন্মুক্ত রাখা হয়েছে।
আশ্রম কমিটির সাধারণ সম্পাদক লিটন সরকার বলেন:শ্রী শ্রী গৌর নিতাই আশ্রমটি মেঘনার ভাঙনের মুখ থেকে রক্ষা পেয়ে আজ ৪০ বছরে পদার্পণ করেছে—এটি আমাদের জন্য অত্যন্ত আনন্দের ও গর্বের। স্থানীয় ভক্তবৃন্দ এবং শুভাকাঙ্ক্ষীদের অকৃপণ অনুদান ও শ্রমে এই মহোৎসব পরিচালিত হচ্ছে। আমরা চেষ্টা করেছি ভক্তদের জন্য সর্বোচ্চ সুন্দর ও নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করতে। আশা করছি সকলের সহযোগিতায় ২৪ প্রহরব্যাপী এই যজ্ঞ সফলভাবে সম্পন্ন হবে।”
উৎসবের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হাইমচর উপজেলা প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিশেষ তৎপরতা দেখাচ্ছে। উপজেলা কর্মকর্তা অমিত রায় বলেন, “দেশের সার্বিক পরিস্থিতি এবং এই বিশাল ধর্মীয় সমাগম বিবেচনা করে প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিশেষ নজরদারি অব্যাহত রয়েছে। আমরা আয়োজক কমিটির সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছি যেন ভক্তরা নির্বিঘ্নে তাদের ধর্মীয় আচার পালন করতে পারেন।”
এই মহোৎসব স্থানীয় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের মুখে হাসি ফুটিয়েছে। আশ্রমের আশেপাশে কয়েকশ অস্থায়ী দোকান গড়ে উঠেছে। হস্তশিল্প, ধর্মীয় সরঞ্জাম, খেলনা এবং মুখরোচক খাবারের দোকানে উপচে পড়া ভিড় দেখা গেছে। এতে স্থানীয় অর্থনীতিতে এক ধরনের চাঞ্চল্য তৈরি হয়েছে।
আগামী রবিবার রাতে নগর পরিক্রমা এবং মহানাম যজ্ঞের পূর্ণাহুতির মধ্য দিয়ে এই মিলনমেলার পর্দা নামবে। তবে ভক্তদের হৃদয়ে এই আধ্যাত্মিক স্পন্দন ও মেঘনা তীরের এই সম্প্রীতির আবহ রয়ে যাবে দীর্ঘকাল।
শিমুল অধিকারী সুমন, চাঁদপুর
সিএ/টিআর


