হাসি সাধারণত আনন্দ, মানসিক প্রশান্তি ও সুস্থতার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়। এটি মানসিক চাপ কমায়, হৃদ্রোগের ঝুঁকি হ্রাস করে এবং শরীরে ‘হ্যাপি হরমোন’ নিঃসরণ ঘটায়। তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো—এই হাসিই হতে পারে মৃত্যুর কারণ। সম্প্রতি ‘দ্য ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নাল’-এ প্রকাশিত এক গবেষণায় উঠে এসেছে এমনই চমকপ্রদ তথ্য।
গবেষণায় দেখা গেছে, অতিরিক্ত বা জোরে হাসা শরীরের অভ্যন্তরীণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গে অস্বাভাবিক চাপ সৃষ্টি করে, যা মারাত্মক জটিলতা তৈরি করতে পারে। ইংল্যান্ডের বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক গত ৭০ বছরে সংগৃহীত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখেছেন, হাসির কারণে কিছু মানুষের ক্ষেত্রে রক্তচাপ হঠাৎ কমে গেছে, কেউ জ্ঞান হারিয়েছেন, কারও আবার হৃদ্স্পন্দনের ছন্দ পরিবর্তিত হয়েছে। এমনকি কিছু ক্ষেত্রে খাদ্যনালি ও স্বরযন্ত্রে ছিদ্র পর্যন্ত তৈরি হয়েছে, যা জরুরি অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন তৈরি করেছে।
গবেষণার বিশদ তথ্য:
গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত ছিল ১৫০টিরও বেশি চিকিৎসা প্রতিবেদন, যেখানে রোগীরা অতিরিক্ত হাসির কারণে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। কিছু রোগীর ক্ষেত্রে দেখা যায়, ‘লাফিং সিনকোপ’ নামে পরিচিত এক ধরনের অজ্ঞান হয়ে পড়ার প্রবণতা দেখা দেয়—যেখানে অতিরিক্ত হাসির ফলে মস্তিষ্কে সাময়িকভাবে রক্তপ্রবাহ কমে যায়।
আরেকটি ঘটনার উদাহরণে, ৫৬ বছর বয়সী এক ব্যক্তি জোরে হাসতে গিয়ে খাদ্যনালিতে ছিদ্র হয়ে গুরুতর অবস্থায় পড়েন। চিকিৎসকরা এটিকে ‘ইসোফেজিয়াল পারফোরেশন’ হিসেবে শনাক্ত করেন।
অতিরিক্ত হাসির শারীরবৃত্তীয় প্রভাব:
বিশেষজ্ঞদের মতে, জোরে হাসলে বুক ও পেটের বহু পেশি একসঙ্গে সঙ্কুচিত হয়, যার ফলে বুকে চাপ সৃষ্টি হয় এবং রক্তচাপের তারতম্য ঘটে। এতে হৃদ্রোগী বা উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের ঝুঁকি বেড়ে যায়। অতিরিক্ত হাসি শরীরের স্নায়ুতন্ত্রেও প্রভাব ফেলে, কখনও কখনও এটি ‘নার্ভ কম্প্রেশন’ বা সাময়িক স্নায়ুবন্ধের কারণ হতে পারে।
অতিরিক্ত হাসির সম্ভাব্য ক্ষতি:
১. রক্তচাপ হঠাৎ কমে যাওয়া: এতে মাথা ঘোরা, বমি ভাব, এমনকি অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।
২. হৃদ্রোগীদের বাড়তি ঝুঁকি: হাসির সময় হঠাৎ হৃদ্স্পন্দন বেড়ে বা কমে গিয়ে হৃদ্যন্ত্রের ছন্দ নষ্ট হতে পারে।
৩. খাদ্যনালি ও স্বরযন্ত্রের ক্ষতি: অতিরিক্ত চাপের ফলে খাদ্যনালির অভ্যন্তরীণ অংশে ফাটল বা ছিদ্র তৈরি হতে পারে।
৪. স্নায়ুর ক্ষতি: দমবন্ধ হাসিতে শরীরের ওপরের অংশে স্নায়ু সংকোচন ঘটে, যা মুখ বা গলার পেশিকে প্রভাবিত করতে পারে।
৫. মল-মূত্র নিয়ন্ত্রণ হারানো: বিশেষ করে বয়স্কদের ক্ষেত্রে হাসির সময় হঠাৎ মূত্র বা মলত্যাগ হয়ে যেতে পারে।
৬. চোখের ক্ষতি: অতিরিক্ত হাসির কারণে চোখে রক্তচাপ বেড়ে গিয়ে সামান্য রক্তপাত হতে পারে।
গবেষকদের পরামর্শ:
হাসি নিঃসন্দেহে মন ও শরীরের জন্য একটি প্রাকৃতিক ওষুধ। তবে যেকোনো কিছুর মতোই এরও সীমা থাকা প্রয়োজন। চিকিৎসকেরা বলছেন, সংযতভাবে হাসুন, শরীরের প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করুন। যদি হাসির সময় মাথা ঘোরা, বুকে ব্যথা বা শ্বাসকষ্ট অনুভব হয়, তাহলে সেটি আর মজার নয়—তাৎক্ষণিক চিকিৎসা নিন।
আনন্দের জন্য হাসা জরুরি, কিন্তু প্রাণের বিনিময়ে নয়। তাই ‘হাসুন, তবে সীমার মধ্যে’—এই বার্তাই দিচ্ছেন গবেষকেরা।
সিএ/এমআর


