ইভান পাল
আমরা জানি আমাদের এ বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস কে ইতিহাসবেত্তা ও বাংলা সাহিত্যের পন্ডিত গণ তিন ভাগে বিভক্ত করেছেন।
প্রথমটি, প্রাচীন যুগ।
দ্বিত্বীয়টি, মধ্যযুগ
এবং
তৃতীয়টি, আধুনিক যুগ।
বিভিন্ন শাসকের শাসনামলে বাংলা সাহিত্যে বিপর্যয় আসে। সকল বাধাঁ বিপর্যয়কে টেক্কা দিয়ে আমাদের এ বাংলা সাহিত্য বিশ্বের অন্য আর দশ টা পাচটাঁ সাহিত্যের মতো ই মাথা উচুঁ করে দাঁড়িয়ে আছে।
এই যে যুগের পরিবর্তন আমাদের এ সাহিত্য জগতে, তাতে কিন্তু আমরা আমাদের বাংলা সাহিত্যে বহু মূল্যবান রত্ন পেয়েছি।
কবিগুরু রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, মাইকেল মধুসুদন দত্ত, মহাকবি আলাওল, অমিয় চক্রবর্ত্তী, কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার,কবিন্দ্র পরমেশ্বর, শ্রীকর নন্দী সহ আরো অনেকে। যা শুরু করলে আমি হয়তো শেষ করতে পারবো না। এই যুগ পরিবর্তনের ছোয়াঁতে আমরা পেয়েছিলাম চর্যাপদ, শ্রীকৃষ্ণ কৃত্তন, শ্রীচৈতন্য দেবের জীবনী, মনসুর বয়াতি কিংবা বেহুলা লক্ষীন্দরের মতো কিছু অসামান্য সৃষ্টি সম্ভার।
আবার, এসব কবি সাহিত্যিকরা কিন্তু একেক জন একেক টি নামে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তাই তাদেরঁ নাম উচ্চারণের পূর্বে সেই ছদ্ম নাম বা উপাধি টুকু উচ্চারণ করলে বাঙালিরা নি:সন্দেহে ধরে নিতে পারবেন কার কথা বলা হচ্ছে।
যেমন: কবিগুরু বা গুরুদেব বললে আমরা বুঝে নেই রবি ঠাকুর এর কথা বলা হচ্ছে। কিংবা বিদ্রোহী কবি বললেই বুঝে নেই কাজী নজরুলের কথা বলা হচ্ছে।।
এরকম ই কিছু ব্যাপার!
কিন্তু, আমি শিরোনামে উল্লেখ করেছি, বাংলাদেশের প্রথম শহীদ সাহিত্যিক।
কেন এমন্টা করেছি। পাঠক মহলে এ প্রশ্ন সহসাই জাগতে পারে। কারণ, এ আবার কেমন কথা, শহীদ আবার সাহিত্যিক ও? আর আগে কখনো কোন পুস্তক বা বইতে এমন টা শোনাও যায়নি।
ঠিক তাই। শহীদ আবার সাহিত্যিক ও। আজ তারঁ ই কথা ই বলব।
আমাদের বাংলা সাহিত্যের প্রথম শহীদ সাহিত্যিক, “সোমেন চন্দ”।
মাত্র চব্বিশটি গল্প, একটি অসম্পূর্ণ উপন্যাস, দুটি নাটিকা এবং তিনটি কবিতা(সোমেন চন্দ রচনাবলি থেকে)। মাত্র একয়টি সৃষ্টি সম্ভার নিয়েই সাহিত্যিক সোমেন চন্দের সাহিত্য জীবন। তবে আরো কিছু গল্প-কবিতা – উপন্যাস ও তারঁ সৃষ্টির ঝুলিতে ছিল। কিন্তু অবহেলা আর অসতর্কতার জন্য তারঁ বহু সৃষ্টি ই হারিয়ে যায়।
জন্মেছিলেন ১৯২০সালে ২৪ শে মে। ঢাকা জেলার নরসিংদি’র বালিয়া গ্রামে। তারঁ পিতা নরেন্দ্রকুমার ছিলেন উদাসীন ভাবুক স্বভাবের মানুষ। সংসারের দিকে নজর না দিয়ে দিয়েছিলেন স্বদেশী আন্দোলনের দিকে।
সোমেন চন্দের শৈশব-কৈশর কেটেছে ঢাকায়।
ভালো নাম — সোমেন্দ্রকুমার চন্দ।মাত্র চার বছর বয়সে হারান তারঁ মমতাময়ী মাকে।
যাক, তারপর জীবনের বেশ কিছু সময় কেটে যায়।
১৯৩৬ সালে পগোজ স্কুল থেকে সফলতার সাথে প্রবেশিকা পরীক্ষায়(ম্যাট্রিক) উত্তীর্ণ হন।
ডাক্তারি পড়তে ভর্তি হন মিটফোর্ড মেডিকেল কলেজ এ। কিন্তু তাতে বাধঁ সাধল আর্থিক কষ্ট আর তারঁ শারীরিক অসুস্থতা। কিন্তু আর্থিক অসুবিধা হয়তো দূর করা যেত। মূল সমস্যা ছিল তারঁ অসুখ। তিনি প্লুরিসিস বা যাকে বর্তমানে ব্রঙ্কাইটিস রোগ বলা হয়, তিনি সে রোগে আক্রান্ত ছিলেন। ফলে, তারঁ আর ডাক্তারি পড়া হল না। শুধু ডাক্তারি ইই নয় ঐ অবস্থা থেকে তারঁ সব রকম প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনায় ভাটা পড়েছিল।যা আর এগুতে পারেনি।
এবার আসি মূল কথায়, কেন তাকেঁ বলা হয় শহীদ সাহিত্যিক সে প্রসঙ্গে।
১৯৩৭ সালের দিকটায় যখন সোমেন চন্দের বয়স ছিল ১৭ বছর, তখন তারঁ পরিবার ঢাকার দক্ষিণ মৈশুন্ডির লাল মোহন স্ট্রিট এ চলে আসেন। আর তখন থেকেই তারঁ জীবনে আসে নতুন মোড়।
১৯৩৮ সালের শেষদিকে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের পথিকৃৎ কমিউনিষ্টরা ঢাকা দক্ষিণের মৈশুন্ডির জোড়পুর লেনে একটা অফিস স্থাপন করেন।
কমিউনিষ্টরা এখানে এখানে একটি গোপন ক্লাস নিত। যার নাম দেওয়া হয়েছিল “প্রগতি পাঠাগার”। এই ক্লাসের মাধ্যমে শ্রমিকশ্রেণী এবং যুব সমাজকে মার্কসবাদ-লেনিন বাদের বৈজ্ঞানিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তোলা হত। আর এই সংগঠনের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন বিল্পবী সতীশ পাকড়াশী।
সোমেন কেমন যেন হঠাতের উপর ই এই সংগঠনের সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে পড়েন।আর সোমেন চন্দ ছিল খুব ই জেদী একজন মানুষ। তারঁ জ্ঞান, দক্ষতা আর আগ্রহ দেখে কমিউনিষ্ট নেতারা সোমেন এর উপর প্রগতি পাঠাগার এর সমস্ত রকম দায়িত্ব তুলে দেন। তবে তিনি তখন ও কমিউনিষ্ট পার্টির আনুষ্ঠানিক সদস্যপদ পান নি। একসময় তিনি সদস্য পদ পেতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। আর ঢাকার কমিউনিষ্টরাও সোমেন এর এই আগ্রহ আর দক্ষতার জন্য তাকেঁ সদস্য পদ দিতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু আবারো বাধঁ সাধল তারঁ শারীরিক অবস্থা। তিনি ছিলেন শারীরিক দিক দিয়ে দুর্বল। তাই কমিউনিষ্ট নেতারাই একটু ইতস্ততার মধ্যে ছিলেন। কারণ, তৎকালীন কমিউনিষ্ট মানেই, যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা। যোদ্ধাই বলা চলে। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই। নিজ মাতৃভূমিকে বাচাতেঁ যুদ্ধ করা।
যাক, শেষ পর্যন্ত ১৯৪১এর কোন এক সময়ে তিনি পেলেন সেই বহুল প্রত্যাশিত কমিউনিষ্ট
পার্টির সদস্যপদ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন কমিউনিষ্ট পার্টি ছিল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কিন্তু, সোমেন এই সময়ে সংগঠন টি টিকিয়ে রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। খুব অল্প সময়ে পরিশ্রম, মেধা আর দক্ষতা কে কাজে লাগিয়ে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। আর তার ই ফলস্বরুপ তিনি ইষ্ট বেঙ্গল রেলওয়ে শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এরপর জীবনের শেষদিন পর্যন্ত বিভিন্ন ক্ষেত্রে দায়িত্ব পালন করেন এ পার্টির হয়ে। অর্থাৎ, বাংলাদেশের কমিউনিষ্ট আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তিত্ব হচ্ছেন সোমেন চন্দ। মার্কসবাদী এই মানুষটি র অবদান ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের ক্ষেত্রে বিরাট সাফল্য বয়ে আনে।
কিন্ত নিয়তি তারঁ কর্মকান্ড কে বেশীদূর এগুতে দেয়নি।
১৯৪২ সালে ৮ই মার্চ। ক্যালেন্ডার এর পাতায় সেদিন ছিল রবিবার। ঢাকার সুত্রাপুরে আয়োজন করা হয়েছে “ফ্যাসিবিরোধী সন্মেলনের”। তো,সোমেন চন্দ একটি মিছিল নিয়ে সেই সন্মেলনেই যোগ দিতে যাচ্ছিলেন। ঠিক, লক্ষীবাজারের দিকে মিছিল নিয়ে যেতেই উগ্র জাতীয়তাবাদী ফরোয়ার্ড ব্লক, আর. এস.পি. এর সমর্থকরা তারঁ এ মিছিলে হামলা চালায়। আর তাকেঁ নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ফ্যাসিবিরোধী এই যোদ্ধা নিহত হলেন সেই ফ্যাসিস্টদের হাতেই। আর একারণেই তাকেঁ বলা হয়ে থাকে “বাংলাদেশের,বাংলা সাহিত্যের প্রথম শহীদ সাহিত্যিক”।
তারঁ এভাবে মৃত্যুতে বিক্ষোভে ফেটে পড়েন ভারতবর্ষের প্রগতিশীল শিল্পী, সাহিত্যিক সমাজ। কিন্তু, অত্যন্ত দু:খের ব্যাপার হলেও সত্য যে– যারা তারঁ ওপর আক্রমণ করেছিল, সেইসব নরপশুরা ধরা ছোয়ার বাইরেই থেকে যায়।
যাক, এবার আসি তারঁ সাহিত্য জীবন নিয়ে। আমি আগেই বলেছি, তারঁ সাহিত্য ঝুলিতে সৃষ্টির পরিমাণ স্বল্প।
তিনি স্কুল জীবন থেকেই সাহিত্য চর্চা করতেন। তারঁ লেখাগুলো বিভিন্ন পত্র পত্রিকাতে ছাপা হত। যেমন: প্রভাতী, সোনার বাংলা, শান্তি,ক্রান্তি ইত্যাদি।
তবে জীবিতকালে তারঁ লেখা কোন গ্রন্থ প্রকাশিত হয়নি।
সোমেন এর মৃত্যুর পর অর্থাৎ ১৮৪২ সালের ডিসেম্বর মাসের দিকে তারঁ প্রথম গল্প গ্রন্থ — “সংকেত ও অন্যান্য গল্প” প্রকাশিত হয়।
এরপর তারঁ দ্বিতীয় গল্প গ্রন্থ “বনস্পতি” প্রকাশ করে কলকাতার মর্ডাণ পাবলিশার্স।
এছাড়াও তারঁ আরো কিছু গল্প রয়েছে। যেমন: স্বপ্ন, সংকেত, রায়ট ইত্যাদি।
আগেই বলেছি, তারঁ অনেক লেখালেখি ই উদ্ধার করা যায়নি। তারঁ একমাত্র অসম্পূর্ণ উপন্যাস “বন্যা” প্রকাশিত হয় বালিগঞ্জ পত্রিকায়।
পরিশেষে, সোমেন চন্দ ছিলেন একজন বিষ্ময়কর প্রতিভা।যিনি কিনা জীবনের শেষ দিন অব্দি করে গেছেন গণ মানুষের আন্দোলন।তারঁ একটি ই স্বপ্ন ছিল শ্রমিক-কৃষক-সাধারণ মানুষের বিজয় সংগ্রাম কে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। আবার করেছেন প্রগতি পাঠাগার এর মাধ্যমে সাহিত্য আন্দোলন।
তারঁ এ গল্পশুনে সত্যিই গাইতে ইচ্ছে হচ্ছে–
মুক্তির মন্দির সোপানতলে
কত প্রাণ হল বলিদান,
লেখা আছে অশ্রুজলে ।।
কত বিপ্লবী বন্ধুর রক্তে রাঙা,
বন্দীশালার ওই শিকল ভাঙ্গা
তাঁরা কি ফিরিবে আজ সু-প্রভাতে,
যত তরুণ অরুণ গেছে অস্তাচলে।।
আর এরকম ই কিছু আত্মত্যাগ এর ফল যেন পরবর্তীতে পাক-বাহিনীর বিরুদ্ধে যাওয়া,প্রতিবাদ আর মুক্তিযুদ্ধে জয়লাভ। আর একটি লাল সবুজের সোনার বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের প্রথম শহীদ – সাহিত্যক সোমেন চন্দ জীবনের শেষদিন পর্যন্ত করে গেছেন মানব মুক্তির গান, স্বাধীনতার গান আর গণ মানুষের গান। তাদের কিংবা তাদের ই মতো কিছু বীরের আত্মত্যাগ শিখিয়েছিল কিভাবে জীবন উৎসর্গ করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হয়, ভালবাসতে হয়।