সৌদি আরবের কড়া আল্টিমেটামের মুখে ইয়েমেনে নিজেদের সামরিক মিশন সমাপ্তির ঘোষণা দিয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। দেশটি জানিয়েছে, খুব শিগগিরই ইয়েমেনে অবস্থানরত সব আমিরাতি সেনাকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে। স্থানীয় সময় মঙ্গরবার এই সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়।
এই ঘোষণার কয়েক ঘণ্টা আগেই সৌদি নেতৃত্বাধীন জোট বাহিনী দক্ষিণ ইয়েমেনের মুকাল্লা বন্দরে হামলা চালায়। ওই হামলার পর অঞ্চলজুড়ে উত্তেজনা আরও তীব্র হয়ে ওঠে।
ইয়েমেনের বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র রাজনৈতিক গোষ্ঠী সাউদার্ন ট্রানজিশনাল কাউন্সিল (এসটিসি)-এর সঙ্গে আমিরাতের ঘনিষ্ঠতা এবং এই ইস্যুতে সৌদি আরবের সঙ্গে তিক্ততা ও আস্থার সংকটের জেরে গতকাল মঙ্গলবার আবুধাবিকে সরাসরি আল্টিমেটাম দেয় রিয়াদ। সৌদি সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আমিরাতি সেনাদের ইয়েমেন ত্যাগ করতে হবে।
বিচ্ছিন্নতাবাদীদের জন্য আমিরাত থেকে পাঠানো অস্ত্র ও সাঁজোয়া যানবাহী চালানে সৌদি নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটের হামলার পর পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয়ে ওঠে। হাজরামাউত ও মাহরা অঞ্চল থেকে সরে যাওয়ার আহ্বান জানানোর পর শুক্রবার এসটিসির অবস্থানেও বিমান হামলা চালানো হয়।
ওয়াশিংটনে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর জানিয়েছে, পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও ইয়েমেন পরিস্থিতি এবং মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয় নিয়ে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন।
কুয়েত ও বাহরাইনসহ কয়েকটি উপসাগরীয় দেশ জানিয়েছে, তারা সংলাপ জোরদার এবং রাজনৈতিক সমাধানে পৌঁছানোর যেকোনো উদ্যোগকে সমর্থন করবে। কাতার বলেছে, সৌদি আরব ও অন্যান্য উপসাগরীয় দেশের নিরাপত্তা তাদের নিজস্ব নিরাপত্তার অবিচ্ছেদ্য অংশ।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে দেওয়া এক বিবৃতিতে আমিরাত সরকার জানায়, ইয়েমেনে তাদের পূর্বনির্ধারিত লক্ষ্য পূরণ হয়েছে এবং এখন দেশটিতে অবস্থানরত সব আমিরাতি সেনাকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে স্বদেশে ফিরিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করা হচ্ছে।
বিশ্লেষকদের মতে, ইয়েমেনের বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী সাউদার্ন ট্রানজিশনাল কাউন্সিলের সঙ্গে আমিরাতের ঘনিষ্ঠতা এবং প্রত্যক্ষ সহযোগিতা সৌদি আরবের জন্য দীর্ঘদিন ধরেই অস্বস্তির কারণ ছিল। এই ইস্যুতে দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক তিক্ততা ও আস্থার সংকট গত মঙ্গলবার চরম পর্যায়ে পৌঁছায়।
পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে সৌদি সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে আবুধাবিকে সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সেনা প্রত্যাহার না হলে আরও কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে। এই নজিরবিহীন আল্টিমেটাম ও সামরিক চাপের মুখে শেষ পর্যন্ত নিজেদের অবস্থান পরিবর্তন করে সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেয় সংযুক্ত আরব আমিরাত।
ইয়েমেনে চলমান সংঘাতের সূচনা হয় ২০১৪ সালে, যখন ইরান-সমর্থিত হুথি বিদ্রোহীরা রাজধানী সানা দখল করে নেয়। এর পর তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আব্দ রাব্বু মনসুর আল-হাদী সৌদি আরবে আশ্রয় নেন।
হুথিদের প্রতিহত করা ও হাদীর সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ইয়েমেনি সরকারি বাহিনীর সমন্বয়ে একটি সামরিক জোট গঠিত হয়। ২০১৫ সাল থেকে ওই জোট ব্যাপক বিমান হামলা ও স্থল অভিযান শুরু করে। তবে দীর্ঘ যুদ্ধের পরও হুথিদের সম্পূর্ণভাবে পরাস্ত করা সম্ভব হয়নি।
২০১৯ সাল থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাত ধীরে ধীরে ইয়েমেনে তাদের সেনা উপস্থিতি কমাতে শুরু করে, যদিও প্রকাশ্যে জোটের প্রতি সমর্থন বজায় রাখে। একই সময়ে আমিরাত-সমর্থিত এসটিসি দক্ষিণ ইয়েমেনে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ বিস্তারে সক্রিয় হয়ে ওঠে, যা সৌদি-সমর্থিত কেন্দ্রীয় সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করে।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে ইয়েমেন থেকে আমিরাতের পূর্ণ সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা দেশটির দীর্ঘ যুদ্ধ পরিস্থিতিতে নতুন বাস্তবতা সৃষ্টি করতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। এখন সৌদি আরব এককভাবে সংঘাত চালাবে নাকি নতুন কোনো কূটনৈতিক কৌশল গ্রহণ করবে—তা নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আলোচনা বাড়ছে।
সিএ/এএ


