Thursday, December 25, 2025
15 C
Dhaka

কমছেই না ডেঙ্গুর ভয়াবহতা, ছড়িয়েছে ৬৩ জেলায়

ডেঙ্গু জ্বরের প্রাদুর্ভাব বর্তমানে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। রাজধানী ঢাকার বাইরে দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে এই মশাবাহিত রোগ, যা স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের জন্য উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের সর্বশেষ তথ্যমতে, দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ৬৩ জেলায় ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে। গত বুধবার একদিনে ১০ জন মারা গেছেন, যা চলতি বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। বিশেষ করে অক্টোবর মাসে আক্রান্তের সংখ্যা সেপ্টেম্বরের তুলনায় ৪২ শতাংশ বেড়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, শুধুমাত্র অক্টোবরেই ডেঙ্গুতে মারা গেছেন ৮০ জন এবং অন্তত ২২,৫২০ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত ৭৫,৯৯২ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এবং ৩০২ জন মারা গেছেন। হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার অ্যান্ড কন্ট্রোল রুমের হিসাবেও দেশের ৬৩ জেলায় ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারি প্রতিবেদনে প্রকাশিত চিত্রের চেয়েও বাস্তব অবস্থা ভয়াবহ। সিভিল সার্জনের কার্যালয় থেকে প্রাপ্ত তথ্য প্রায়ই প্রকৃত পরিস্থিতি প্রকাশ করতে ব্যর্থ হয়। তাই ডেঙ্গু এখন মরণব্যাধির রূপ নিচ্ছে।

ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও চিকিৎসার বিকেন্দ্রীকরণ

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গুর ভয়াবহতা নিয়ন্ত্রণে আনতে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। তারা পরামর্শ দিচ্ছেন, প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা শুধু সিটি করপোরেশন বা পৌরসভার ওপর ছেড়ে না দিয়ে এটিকে স্থানীয় সরকারের সমন্বিত দায়িত্ব হিসেবে দেখা হোক। এছাড়া সারাদেশে ডেঙ্গুর চিকিৎসা বিকেন্দ্রীকরণের ওপর জোর দিতে হবে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মোশতাক হোসেন বলেন, “ডেঙ্গুতে মৃত্যুহার কমাতে হলে আগেভাগে শনাক্তকরণ এবং স্বাস্থ্যসেবা বিকেন্দ্রীকরণ জরুরি। রোগীরা যদি নিজের এলাকার কাছাকাছি পরীক্ষা করতে পারতেন, তবে রোগ শুরুতেই শনাক্ত করা যেত। এখন রোগীদের বড় হাসপাতালে যেতে হয় এবং ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়, ফলে ঝুঁকিপূর্ণ সময় মিস হয়ে যায়।” তিনি আরও বলেন, কোভিড-১৯ পরীক্ষার মতো কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে ডেঙ্গু পরীক্ষা চালু করলে হাসপাতালে চাপ কমবে এবং রোগী সময়মতো সেবা পাবেন।

তরুণরা বেশি ঝুঁকিতে

বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, ২১ থেকে ৩৫ বছর বয়সী তরুণরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছেন। জীবন ও জীবিকার চাপে তারা ঘরের বাইরে বিভিন্ন স্থানে কাজ করছেন, যার ফলে এডিস মশার প্রভাব বেশি পড়ছে। শ্রমজীবী মানুষ, বাজার-ঘাট বা নির্মাণকাজে নিয়োজিতরা মূলত আক্রান্ত হচ্ছেন। তবে মৃত্যুর সংখ্যা বয়স্ক ও শিশুদের তুলনায় কম হলেও, তরুণদের মধ্যে আক্রান্তের সংখ্যা উদ্বেগজনক।

ডা. তারিকুল ইসলাম লিমন বলেন, “ডেঙ্গু এখন আর সিজনাল রোগ নয়। সারাবছরই এর প্রকোপ দেখা যাচ্ছে। বৃষ্টি শুরু হলে এটি আরও বাড়ছে। বাসা-বাড়ি পরিষ্কার রাখা, তিন দিনের বেশি জমে থাকা পানি, কাপ, টব, ভাঙা টায়ার, ডাবের খোসা, প্লাস্টিক পাত্রে পানি জমা থাকা এড়াতে হবে। অপ্রয়োজনীয় জিনিস ফেলে দিতে হবে।”

মৃত্যুহার বৃদ্ধি ও চিকিৎসা জটিলতা

মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. এইচ এম নাজমুল আহসান বলেন, “রোগীরা হাসপাতালে আসার সময় প্রায়শই মারাত্মক অবস্থায় থাকেন। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পরপরই অনেক রোগীর মৃত্যু হয়। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ, একাধিক অঙ্গ বিকল হয়ে যাওয়া, গর্ভাবস্থা বা দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা মৃত্যুহার বাড়ায়। ঢাকার বাইরে থেকে রোগী রেফার হলে এবং প্রাথমিক সেবা না পেলে অবস্থার অবনতি হয়। দক্ষিণ ঢাকায় মৃত্যুর সংখ্যা বেশি, কারণ সংকটাপন্ন রোগীরা এখানে রেফার হয়।”

ডেঙ্গুর বিস্তার ও কারণ

কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক কবীরুল বাশার বলছেন, কয়েক বছর ধরে বর্ষা দেরিতে আসায় এবং স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর নিষ্ক্রিয়তার কারণে ডেঙ্গু ছড়াচ্ছে। অপরিকল্পিত নগরায়ন, জলবায়ু পরিবর্তন ও সুশাসনের অভাব এই রোগের বিস্তারে প্রধান কারণ। সিটি করপোরেশন, স্বাস্থ্য অধিদফতর, স্থানীয় সরকার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও জনগণ একসঙ্গে কাজ না করলে ডেঙ্গুর এই বলয় থেকে বের হওয়া সম্ভব হবে না।

সতর্কবার্তা

বিশেষজ্ঞরা বারবার সতর্ক করে বলছেন, সময়মতো প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা না নিলে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা আরও বাড়বে। হাসপাতাল ও কমিউনিটি ক্লিনিকে দ্রুত পরীক্ষা-নির্ণয় এবং সচেতনতা বৃদ্ধিই এই রোগ নিয়ন্ত্রণের মূল চাবিকাঠি।

সিএ/এমআরএফ

spot_img

আরও পড়ুন

৫ দফা দাবিতে ৯ জানুয়ারি ঢাকায় ইসলামী আন্দোলনের মহাসমাবেশ

শহীদ ওসমান হাদি হত্যার বিচার, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নসহ পাঁচ...

গাজীপুরে ট্রেনে কাটা পড়ে তিনজন নিহত

গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলায় ট্রেনে কাটা পড়ে তিনজনের মর্মান্তিক মৃত্যু...

দেশে ফিরে ইতিহাস গড়েছিলেন যেসব বিশ্বনেতা

রাজনীতিতে ‘ফিরে আসা’ অনেক সময় কেবল ব্যক্তিগত প্রত্যাবর্তন নয়;...

র‍্যাবের অভিযানে ৪ মণ গাঁজা ও ফেনসিডিলসহ ৫ মাদক কারবারি গ্রেপ্তার

নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরে পৃথক দুটি অভিযানে প্রায় চার মণ...

কে এই মার্টিন লুথার কিং?

দীর্ঘ ১৭ বছর পর দেশে ফিরে রাজধানীর ৩০০ ফিট...

ইসমাইল-ইমন হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার ৩

চট্টগ্রাম নগরীর হালিশহর থানার ইসমাইল হত্যা মামলা এবং চাঁদগাঁও...

মাকে দেখতে এভারকেয়ার হাসপাতালে তারেক রহমান

চিকিৎসাধীন মায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে পৌঁছেছেন...

তারেক রহমানের বক্তব্যে মুগ্ধ পরীমনি

দীর্ঘ ১৭ বছর পর দেশে ফিরে রাজধানীর পূর্বাচলে আয়োজিত...

আদালতে গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্য দিলেন হাদি বহনকারী অটোরিকশাচালক

ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান বিন হাদি হত্যা মামলায়...

গণসংবর্ধনাস্থলে পৌঁছাতে ৩ ঘণ্টার বেশি সময় লাগল তারেক রহমানের

কয়েক লাখ নেতা–কর্মী ও সাধারণ মানুষের ভিড় ঠেলে ঢাকার...

কড়া নিরাপত্তায় এগোচ্ছে তারেক রহমানের গাড়িবহর

ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে রাজধানীর পূর্বাচলে আয়োজিত...

স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তারেক রহমানের ফোনালাপ

ঢাকায় নেমে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বললেন তারেক...

ফেরার আগে তাসকিন-মোস্তাফিজুরের ঝুলিতে উইকেট

দুবাইয়ে ইন্টারন্যাশনাল লিগ টি-টোয়েন্টিতে নিজেদের শেষ ম্যাচ খেলেছেন বাংলাদেশের...
spot_img

আরও পড়ুন

৫ দফা দাবিতে ৯ জানুয়ারি ঢাকায় ইসলামী আন্দোলনের মহাসমাবেশ

শহীদ ওসমান হাদি হত্যার বিচার, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নসহ পাঁচ দফা দাবিতে রাজধানী ঢাকায় মহাসমাবেশ করার ঘোষণা দিয়েছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। আগামী ৯ জানুয়ারি (শুক্রবার)...

গাজীপুরে ট্রেনে কাটা পড়ে তিনজন নিহত

গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলায় ট্রেনে কাটা পড়ে তিনজনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। বৃহস্পতিবার (২৫ ডিসেম্বর) বিকেলে টঙ্গী–ভৈরব রেলপথের আড়িখোলা রেলস্টেশন সংলগ্ন এলাকায় এই দুর্ঘটনা ঘটে। নিহতদের...

দেশে ফিরে ইতিহাস গড়েছিলেন যেসব বিশ্বনেতা

রাজনীতিতে ‘ফিরে আসা’ অনেক সময় কেবল ব্যক্তিগত প্রত্যাবর্তন নয়; কখনো কখনো তা একটি রাষ্ট্রের ভাগ্য বদলে দেওয়ার মুহূর্ত হয়ে ওঠে। বিশ্বরাজনীতির ইতিহাসে নির্বাসন, দেশত্যাগ...

আপনার নেতৃত্বে এ দেশে শান্তি ফিরুক: তারেক রহমানকে খায়রুল বাসারের শুভেচ্ছা

দীর্ঘ ১৭ বছর পর দেশে ফিরে রাজধানীর ৩০০ ফিট এলাকার ৩৬ জুলাই এক্সপ্রেসওয়েতে আয়োজিত গণসংবর্ধনা অনুষ্ঠানে ভাষণ দিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তাঁর...
spot_img