ডেঙ্গু জ্বরের প্রাদুর্ভাব বর্তমানে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। রাজধানী ঢাকার বাইরে দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে এই মশাবাহিত রোগ, যা স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের জন্য উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের সর্বশেষ তথ্যমতে, দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ৬৩ জেলায় ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে। গত বুধবার একদিনে ১০ জন মারা গেছেন, যা চলতি বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। বিশেষ করে অক্টোবর মাসে আক্রান্তের সংখ্যা সেপ্টেম্বরের তুলনায় ৪২ শতাংশ বেড়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, শুধুমাত্র অক্টোবরেই ডেঙ্গুতে মারা গেছেন ৮০ জন এবং অন্তত ২২,৫২০ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত ৭৫,৯৯২ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এবং ৩০২ জন মারা গেছেন। হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার অ্যান্ড কন্ট্রোল রুমের হিসাবেও দেশের ৬৩ জেলায় ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারি প্রতিবেদনে প্রকাশিত চিত্রের চেয়েও বাস্তব অবস্থা ভয়াবহ। সিভিল সার্জনের কার্যালয় থেকে প্রাপ্ত তথ্য প্রায়ই প্রকৃত পরিস্থিতি প্রকাশ করতে ব্যর্থ হয়। তাই ডেঙ্গু এখন মরণব্যাধির রূপ নিচ্ছে।
ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও চিকিৎসার বিকেন্দ্রীকরণ
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গুর ভয়াবহতা নিয়ন্ত্রণে আনতে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। তারা পরামর্শ দিচ্ছেন, প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা শুধু সিটি করপোরেশন বা পৌরসভার ওপর ছেড়ে না দিয়ে এটিকে স্থানীয় সরকারের সমন্বিত দায়িত্ব হিসেবে দেখা হোক। এছাড়া সারাদেশে ডেঙ্গুর চিকিৎসা বিকেন্দ্রীকরণের ওপর জোর দিতে হবে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মোশতাক হোসেন বলেন, “ডেঙ্গুতে মৃত্যুহার কমাতে হলে আগেভাগে শনাক্তকরণ এবং স্বাস্থ্যসেবা বিকেন্দ্রীকরণ জরুরি। রোগীরা যদি নিজের এলাকার কাছাকাছি পরীক্ষা করতে পারতেন, তবে রোগ শুরুতেই শনাক্ত করা যেত। এখন রোগীদের বড় হাসপাতালে যেতে হয় এবং ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়, ফলে ঝুঁকিপূর্ণ সময় মিস হয়ে যায়।” তিনি আরও বলেন, কোভিড-১৯ পরীক্ষার মতো কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে ডেঙ্গু পরীক্ষা চালু করলে হাসপাতালে চাপ কমবে এবং রোগী সময়মতো সেবা পাবেন।
তরুণরা বেশি ঝুঁকিতে
বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, ২১ থেকে ৩৫ বছর বয়সী তরুণরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছেন। জীবন ও জীবিকার চাপে তারা ঘরের বাইরে বিভিন্ন স্থানে কাজ করছেন, যার ফলে এডিস মশার প্রভাব বেশি পড়ছে। শ্রমজীবী মানুষ, বাজার-ঘাট বা নির্মাণকাজে নিয়োজিতরা মূলত আক্রান্ত হচ্ছেন। তবে মৃত্যুর সংখ্যা বয়স্ক ও শিশুদের তুলনায় কম হলেও, তরুণদের মধ্যে আক্রান্তের সংখ্যা উদ্বেগজনক।
ডা. তারিকুল ইসলাম লিমন বলেন, “ডেঙ্গু এখন আর সিজনাল রোগ নয়। সারাবছরই এর প্রকোপ দেখা যাচ্ছে। বৃষ্টি শুরু হলে এটি আরও বাড়ছে। বাসা-বাড়ি পরিষ্কার রাখা, তিন দিনের বেশি জমে থাকা পানি, কাপ, টব, ভাঙা টায়ার, ডাবের খোসা, প্লাস্টিক পাত্রে পানি জমা থাকা এড়াতে হবে। অপ্রয়োজনীয় জিনিস ফেলে দিতে হবে।”
মৃত্যুহার বৃদ্ধি ও চিকিৎসা জটিলতা
মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. এইচ এম নাজমুল আহসান বলেন, “রোগীরা হাসপাতালে আসার সময় প্রায়শই মারাত্মক অবস্থায় থাকেন। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পরপরই অনেক রোগীর মৃত্যু হয়। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ, একাধিক অঙ্গ বিকল হয়ে যাওয়া, গর্ভাবস্থা বা দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা মৃত্যুহার বাড়ায়। ঢাকার বাইরে থেকে রোগী রেফার হলে এবং প্রাথমিক সেবা না পেলে অবস্থার অবনতি হয়। দক্ষিণ ঢাকায় মৃত্যুর সংখ্যা বেশি, কারণ সংকটাপন্ন রোগীরা এখানে রেফার হয়।”
ডেঙ্গুর বিস্তার ও কারণ
কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক কবীরুল বাশার বলছেন, কয়েক বছর ধরে বর্ষা দেরিতে আসায় এবং স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর নিষ্ক্রিয়তার কারণে ডেঙ্গু ছড়াচ্ছে। অপরিকল্পিত নগরায়ন, জলবায়ু পরিবর্তন ও সুশাসনের অভাব এই রোগের বিস্তারে প্রধান কারণ। সিটি করপোরেশন, স্বাস্থ্য অধিদফতর, স্থানীয় সরকার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও জনগণ একসঙ্গে কাজ না করলে ডেঙ্গুর এই বলয় থেকে বের হওয়া সম্ভব হবে না।
সতর্কবার্তা
বিশেষজ্ঞরা বারবার সতর্ক করে বলছেন, সময়মতো প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা না নিলে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা আরও বাড়বে। হাসপাতাল ও কমিউনিটি ক্লিনিকে দ্রুত পরীক্ষা-নির্ণয় এবং সচেতনতা বৃদ্ধিই এই রোগ নিয়ন্ত্রণের মূল চাবিকাঠি।
সিএ/এমআরএফ


