দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ‘রক্তক্ষরণ’-এর সঙ্গে তুলনা করে ব্যবসায়ী সমাজের প্রতি সরকারের উদাসীনতার অভিযোগ তুলেছেন বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজ (বিসিআই)-এর সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী পারভেজ। তিনি বলেন, দেশের অর্থনীতির রক্তক্ষরণ হচ্ছে। আমরা চিৎকার করলেও সরকার শুনছে না। তারা ব্যবসায়ী মহলের কেয়ার করছেন না।
বৃহস্পতিবার (২৭ নভেম্বর) বনানীর পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) কার্যালয়ে সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আয়োজিত মাসিক অর্থনৈতিক পর্যালোচনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন আনোয়ার উল আলম চৌধুরী পারভেজ। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন পিআরআইয়ের চেয়ারম্যান জাইদী সাত্তার এবং মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সংস্থাটির প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. আশিকুর রহমান।
আনোয়ার উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, ২০২২ সালের পর থেকে জ্বালানি সরবরাহ সংকট ক্রমশ বেড়েছে। সরকার দাম বাড়ালেও বাজারে পর্যাপ্ত জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারেনি, ফলে উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। প্রায় ৫০ শতাংশ ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। এদের মধ্যে অনেকেই ঢাকায় এসে টেসলা (অটোরিকশা) চালাতে বাধ্য হচ্ছে। তিনি জানান, এই শহরের জনসংখ্যা ইতোমধ্যে সাড়ে তিন কোটিতে পৌঁছেছে।
তিনি ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের অবস্থা নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তাঁর ভাষায়, যখন খেলাপি ঋণ ১৭ শতাংশ ছিল, তখন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বাংলাদেশকে ‘মধ্যম ঝুঁকিপূর্ণ’ বলে চিহ্নিত করেছিল। বর্তমানে তা ৩৫ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। এই অস্বাভাবিক ঋণ বৃদ্ধি দেশের ঋণব্যয় বাড়াচ্ছে এবং উৎপাদনমুখী খাতে ঋণপ্রবাহ আরও সংকুচিত করছে।
অনুষ্ঠানে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআই) সেন্টার ফর ম্যাক্রোইকোনমিক অ্যানালাইসিস (সিএমইএ) সেপ্টেম্বর-অক্টোবর সংস্করণের এমএমআই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রপ্তানি বৃদ্ধি, রেমিট্যান্স প্রবাহ এবং মুদ্রাস্ফীতি কিছুটা কমে আসায় অর্থনীতিতে প্রাথমিক স্থিতিশীলতার আভাস মিলেছে। তবে বিনিয়োগ কমে যাওয়া, বেসরকারি ঋণপ্রবৃদ্ধি মন্থর থাকা এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে সামগ্রিক পুনরুদ্ধার এখনও নাজুক।
প্রতিবেদনে সতর্ক করা হয়েছে, দেশের অনাদায়ী ঋণ ২৫ বছরে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে, যা পুরো আর্থিক খাতকেই ঝুঁকির মুখে ফেলেছে। বিনিয়োগ, ঋণপ্রবাহ ও মুদ্রাস্ফীতি—এই পুরো চক্রে এনপিএল এখন ‘বিষাক্ত চাপ’ তৈরি করছে।
পিআরআইয়ের চেয়ারম্যান জাইদী সাত্তার বলেন, অর্থনীতির গতি কমলেও কিছুটা স্থিতিশীলতা এসেছে। কর্মসংস্থান বাড়াতে আরও উদার নীতি গ্রহণ করতে হবে। তিনি উল্লেখ করেন, পাল্টা শুল্কের প্রভাবে রপ্তানি কিছুটা কমলেও বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে এখনও ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে ভালো অবস্থানে আছে।
পিআরআইয়ের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. আশিকুর রহমান বলেন, বাংলাদেশে এনপিএল-সংকট এমন মাত্রায় পৌঁছেছে যা মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সমন্বিত সমাধান কাঠামো প্রয়োজন। তিনি বলেন, ৬.৪ ট্রিলিয়ন টাকার অনাদায়ী ঋণের বোঝা নিয়ে ব্যাংকগুলো টিকতে পারছে না। উচ্চ সুদহার বজায় রাখা, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তারল্য সহায়তার ওপর নির্ভরতা এবং উৎপাদন খাতে ঋণপ্রবাহ কমে যাওয়া– সব মিলিয়ে দেশ একটি ‘উচ্চ সুদ, উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি ও নিম্ন বিনিয়োগের’ দুষ্টচক্রে রয়েছে।
প্যানেল আলোচনায় অংশ নেন এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. নাসিরউদ্দিন আহমেদ, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. একেএম আতিউর রহমান, বিল্ড-এর গবেষণা পরিচালক ড. ওয়াসেল বিন সাদাতসহ অন্যান্যরা। তারা করনীতি, রপ্তানি বৈচিত্র্য, দক্ষতা উন্নয়ন এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে দেশের অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ পূর্বশর্ত হিসেবে চিহ্নিত করেন।
সিএ/এমআরএফ


