২০২৫ সাল শেষ হতে চললেও বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের জীবনরেখা খ্যাত তিস্তা নদীর ভাগ্য বদলায়নি। একদিকে ভারতের সঙ্গে পানি বণ্টন চুক্তির দীর্ঘসূত্রতা, অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ঘনঘন বন্যা ও ভাঙনে জর্জরিত নদীপাড়ের লক্ষ লক্ষ মানুষ। এই বছর তিস্তা নদীকে ঘিরে কূটনৈতিক তৎপরতা, মহাপরিকল্পনার নতুন ঘোষণা এবং প্রকৃতির রুদ্ররূপ—সব মিলিয়ে উত্তরের জনপদে ছিল চরম উদ্বেগ।
২০২৫ সালেও তিস্তা পানি বণ্টন চুক্তি আলোর মুখ দেখেনি। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এবং পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের মধ্যকার অভ্যন্তরীণ মতভেদে চুক্তিটি এখনো ঝুলে আছে। বছরের মাঝামাঝি সময়ে ওমানে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টাদের বৈঠক হলেও কোনো কার্যকর সমাধান আসেনি। ২০২৬ সালে গঙ্গা পানি বণ্টন চুক্তির মেয়াদ শেষ হতে চলায় বর্তমানে দুই দেশের মনোযোগ গঙ্গার দিকে বেশি, যা তিস্তা ইস্যুকে কিছুটা আড়ালে ঠেলে দিয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

চুক্তি না হওয়ায় বাংলাদেশ সরকার নিজস্ব অর্থায়নে ‘তিস্তা মহাপরিকল্পনা’ বাস্তবায়নের ওপর জোর দিয়েছে। পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্পে নদী খনন, দুই তীরে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ এবং স্যাটেলাইট সিটি ও অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ার পরিকল্পনা রয়েছে। এই প্রকল্পে চীন ও ভারত উভয় দেশই বিনিয়োগে আগ্রহ দেখালেও ভূ-রাজনৈতিক জটিলতায় বিষয়টি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। তবে পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান জানিয়েছেন, ২০২৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্পটির একটি টেকসই ভিত্তি তৈরির লক্ষ্য নিয়ে কাজ চলছে।
২০২৫ সালে আবহাওয়া ছিল তিস্তা অববাহিকার জন্য অত্যন্ত প্রতিকূল। জুলাই ও আগস্ট মাসে গজলডোবা ব্যারাজ থেকে অতিরিক্ত পানি ছেড়ে দেওয়ায় নীলফামারী, লালমনিরহাট ও রংপুরে ব্যাপক বন্যা দেখা দেয়। অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহে (৫-৬ অক্টোবর) বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপ ও উজানের ঢলে ডালিয়া পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ৪০ সেমি ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। সিকিমে তিস্তা-৩ বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর থেকে উজানের পানি প্রবাহের ধরন অনিয়মিত হয়ে পড়েছে, যার ফলে অসময়েও বন্যার কবলে পড়ছে চরাঞ্চলগুলো।
নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ না থাকায় মাছের প্রজনন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বর্ষার প্লাবনে মৎস্য খামারিরা লোকসানের মুখে পড়েছেন। এর সাথে মরার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘অবৈধ বালু উত্তোলন’। নীলফামারীর ডিমলা ও লালমনিরহাটের হাতীবান্ধাসহ বিভিন্ন পয়েন্টে শক্তিশালী মেশিনে বালু তোলার ফলে নদীর গতিপথ পরিবর্তন হচ্ছে এবং নদী ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করছে। প্রশাসনের অভিযান সত্ত্বেও অবৈধ এই কার্যক্রম বন্ধ করা সম্ভব হয়নি।
তিস্তা তীরের মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি কেবল ত্রাণ নয়, বরং পানির ন্যায্য হিস্যা এবং নদী শাসন। নদী বাঁচাও আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের মতে, দ্রুত মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন শুরু না করলে উত্তরের কৃষি ও অর্থনীতি মরুভূমিতে পরিণত হওয়ার ঝুঁকিতে পড়বে।
সাব্বির হোসেন, লালমনিরহাট প্রতিনিধি
সিএ/জেএইচ


