ভোটের সময় ঘনিয়ে এলেই রাজনৈতিক উত্তাপ বাড়ে—এটাই স্বাভাবিক। তবে বরিশাল বিভাগের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি সেই স্বাভাবিক উত্তাপকে ছাড়িয়ে গিয়ে এখন ছায়াযুদ্ধের রূপ নিয়েছে। প্রচারণার শুরুতেই কোথাও সংঘর্ষ, কোথাও প্রকাশ্য হুমকিমূলক বক্তব্য—সব মিলিয়ে রাজনৈতিক পরিবেশ অস্বস্তিকর হয়ে উঠছে। ঘটনাগুলো আলাদা মনে হলেও এগুলো একত্র করলে স্পষ্ট হয়, একই রাজনৈতিক দলকে লক্ষ্য করেই ধারাবাহিক হামলা চলছে। এতে প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর সম্পর্ক দ্রুত খারাপ হচ্ছে এবং মাঠের রাজনীতিতে বাড়ছে অস্থিরতা। প্রশ্ন উঠছে—এসব কি কাকতালীয়, নাকি বড় কোনো ঘটনার ইঙ্গিত?
গত এক সপ্তাহের ঘটনাগুলো সেই সন্দেহকে আরও জোরদার করেছে। রোববার (৭ ডিসেম্বর) ঝালকাঠির নলছিটির মোল্লারাটে জামায়াতের কয়েকজন কর্মী হামলার শিকার হন। স্থানীয়রা জানাচ্ছেন, ঘটনার আগে দুই সপ্তাহ ধরে এলাকায় উত্তেজনা বাড়ছিল। একই দিন বরিশাল নগরের কাশীপুরে বিএনপি সমর্থিত এক সাবেক কাউন্সিলরের অনুসারীদের হামলায় আরও একজন জামায়াতকর্মী আহত হন। দুই জেলায় একই দিনে একই দলের কর্মীদের ওপর এমন হামলার ঘটনা অনেকের কাছে বিচ্ছিন্ন নয়, বরং একটি ধারাবাহিক প্রবণতার অংশ বলে মনে হচ্ছে।
এর আগের দিন মুলাদীর মীরগঞ্জ ফেরিঘাটে ছাত্রদলের একটি অংশ এবি পার্টির সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদকে লাঞ্ছিত করে। ফেরিঘাটের দোকানিদের দাবি, এটি ছিল পরিকল্পিত হামলা। স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, হামলার আগে কয়েকজনকে ফোনে নির্দেশনা নিতে দেখা গেছে। এবি পার্টির অভিযোগ, বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের কয়েকজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন।
গত শুক্রবার (৫ ডিসেম্বর) বাউফলের কনকদিয়া বাজারে জামায়াত নেতা রাসেদুল ইসলামের ওপর ‘ওত পেতে’ হামলার অভিযোগ উঠে। সব মিলিয়ে অন্তত ছয়টি ঘটনায় একই দলকে লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, এটিকে কাকতালীয় বলা কঠিন, বরং চাপ প্রয়োগের একটি প্যাটার্ন তৈরি হচ্ছে। দুই দলের শীর্ষ পর্যায়ে এটি অস্বস্তি তৈরি করছে, যদিও তৃণমূল পর্যায়ের কর্মীদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক এখনো তুলনামূলক ভালো। কিন্তু কেন্দ্রীয় অবস্থান তাদের বিপাকে ফেলছে।
ঘটনার পাশাপাশি বক্তব্যের ভাষাও ক্রমেই উত্তপ্ত হচ্ছে। ভোলার এক জনসভায় বিএনপির শীর্ষ নেতা হাফিজ ইব্রাহিম বলেন, ‘২০০০ সালের মতো জামায়াতকে ধরে ধরে পুলিশের হাতে দিতে হবে।’ তার এই বক্তব্যের পর এলাকায় উত্তেজনা বেড়ে যায় বলে স্থানীয়রা জানান। নেতাদের বক্তব্য মাঠে থাকা কর্মীদের মধ্যে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে, যা অস্থিরতাকে আরও উসকে দিচ্ছে।
এদিকে, গৌরনদীর একটি ওয়াজ মাহফিলে বিএনপিরই আরেক নেতার বক্তব্যও বিতর্ক তৈরি করেছে। সভা ছাড়তে থাকা মানুষদের উদ্দেশ করে তিনি বলেন, ‘চিনে রাখলাম আপনাদের।’ স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, ধর্মীয় সমাবেশে এমন বক্তব্য বিভিন্ন দলের উপস্থিত কর্মীদের মধ্যে উত্তেজনা বাড়িয়ে দিচ্ছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ভোট যত ঘনিয়ে আসছে, বরিশাল বিভাগের পরিস্থিতি ততই জটিল হয়ে উঠছে। হামলার পুনরাবৃত্তি, বক্তব্যে হুমকি, এবং সম্পর্কের অবনতি—সব মিলিয়ে বড় ধরনের উত্তেজনার আশঙ্কা বাড়ছে।
সুজনের বরিশাল জেলা কমিটির সম্পাদক রনজিত দত্ত বলেন, বিএনপি–জামায়াত সম্পর্ক এখন স্পষ্ট টানাপোড়েনে। একসময় একই প্ল্যাটফর্মে থাকা দুই দলের এই অবস্থান মাঠের সহনশীলতা কমিয়ে দিচ্ছে।
জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের তিনজন কর্মকর্তা এ বিষয়ে সরাসরি মন্তব্য না করলেও একজন জেলা প্রশাসক পরিচয় গোপন রাখার শর্তে জানান, বক্তব্যের ভাষা তীব্র হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মাঠে ঘটনার সংখ্যাও বাড়ছে। তার মতে, রাজনৈতিক বক্তব্যই এখন সহিংসতার পথ তৈরি করছে এবং দুই পক্ষ সহনশীল না হলে বড় অঘটনের ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে।
এবি পার্টির সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার ফুয়াদ ৮ ডিসেম্বর সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘এভাবে চললে সুষ্ঠু ভোটের সম্ভাবনা কমে যাবে।’ বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অ্যাড. মুয়াযযম হোসাইন হেলাল বলেন, ‘হামলা–হুমকি বাড়লে মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকে না। প্রশাসন নিরপেক্ষ না হলে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন সম্ভব নয়।’ অপরদিকে কেন্দ্রীয় বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক (বরিশাল) বিলকিস জাহান শিরিন মনে করেন, তফসিল ঘোষণার আগে ভোটারদের মধ্যে কিছুটা অনিশ্চয়তা ছিল এবং পূর্বঘোষিত প্রার্থীদের প্রচারণার সময় বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ঘটেছে। তিনি বলেন, তফসিল ঘোষণা হলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে।
সিএ/এএ


