আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ
আজকের এই রাত্রিতে হঠাৎ কেন যেন মনে পড়ছে পেছনে ফেলে আসা বোর্ডিংয়ের (হোস্টেল) সময়টাকে। এখন ঘড়িতে সাড়ে দশটা। সারাদিনের পড়া শেষে এবার ঘুমের ছুটি। দারুল ইকামার নাজেম (হল সুপার) এসে বাতি নিভিয়ে দিতে বলেছেন, এই তাঁর দিনের শেষ আগমন। এরপর দরোজা এঁটে জরুরি বাতি গুলো নিভিয়ে আমাদের স্বাধীন জীবন শুরু। যে ফেসবুকে আসক্ত, টুকটাক দু একটা খবর পড়ে রাজা উজির মেরে একটা পোস্ট দিয়ে দেবে এখনই। যার কণ্ঠ ভাল সে ঘরের এককোণে স্বীয় প্রতিভা বিকাশে ব্যস্ত। দলবদ্ধ কোরাসে সে সুর ক্রমে ক্রমে হয়ে উঠছে চিৎকার। ধীরে ধীরে আলো নিভে আসে। একজন দুজন স্বচালিত ইঞ্জিন (নাক) ছেড়ে জানিয়ে দেয় রাত হয়েছে। মশারির খোপে খোপে বুনে ওঠে আড্ডার জাল। ফিসফিস গল্প, চেপে রাখা হাসি আর আলতো চিমটি চাপড়ে সেইসব জমাটি রাত গভীর থেকে গভীরতর হয়ে ওঠে। কোন কোন দিন জানলা গলে উঁকি দেয় রাতের চাঁদ। ঠিক তক্ষুণি কারো মনে পড়ে নিজ চোখে দেখা ভুতের গল্প। ভয়কাতুরে অন্যজন অনুনয় করে ‘বাদ দে না!’
আহা সময়ের হাওয়ায় উড়ে যাওয়া সেইসব রাত্রিরা আজ কোথায়। কোথায় সেই লুকোন গল্পের ঝুড়ি! অথচ প্রথম যখন গুটিগুটি পায়ে এসেছিলাম এখানে, সদা প্রাণে ভয় না জানি কী হয়! সেই দুরুদুরু দিন, দুষ্টুমি ভরা বিকেলগুলো হাসি আনন্দে ভরে তুলতে তুলতে জানা গেল পরীক্ষা আসছে। এ আবার কী হ্যাপা, যে-করে হোক জীবনের প্রথম পরীক্ষার সাঁকো পেরিয়ে আসলাম বটে কিন্তু কদিন পরই বাতাসে ভাসতে লাগল একটা খবর – ফল বের হবে! তখনকার ছোট মগজ, তারচেয়ে হাজারগুণ বড় কৌতুহলকে কিছুতেই বাগ মানানো যায় না। ফল থাকে ফ্রিজের ওপর ঝুড়িতে, ফল থাকে বাজারে থরে থরে সাজানো। প্রতিদিন আসতে যেতে সেই ফলের ঘ্রাণে প্রাণ উচাটন হয়ে ওঠে। কিন্তু এ আবার কেমন ফল, যা কিনা বের হবে। ছেলেদের আমসি হয়ে যাওয়া মুখ দেখে হতবাক হওয়া বিকেল বেলায় স্যার এসে সবাইকে ডাকলেন, ফল দেওয়া হবে। খাতা দেখে দেখে নাম ঘোষণা হচ্ছে, কেউ ফল পেলো বিশ, কারো দশ, এমনকি নিত্যদিন একসাথে ব্যাগ ঝুলিয়ে গল্প করতে করতে আসি যার সাথে—হাসান, ও-ও পেয়ে গেল বারো না কত যেন। আমার বেলায় কষ্টেসৃষ্টে দুই। তাই তো বলি, ছেলেরা অমন মুখ আমসি করে বসে ছিল কেন!
বিকেল বেলা হালকা সবুজ রঙের ফলবান কাগজটি হাতে নিয়ে যখন মিনমিন করে ক্ষেদটুকু জানালাম, ফল দেবার বেলা আমার পাতে বড্ড কম পড়েছে, আম্মু তো হেসেই…আব্বু এলেন, চিপসের প্যাকেট হাতে কাকা এলেন, সবার মুখে সেই হাসি। বলেন কিনা পরীক্ষার ফল কম পাওয়াই দস্তুর, যত কম নাম্বার তত বড় পড়ুয়া। কী জানি, অমন গোলমেলে হিসাব মাথায় ঢুকলো কিনা। অবশ্য মনে আছে পরের পরীক্ষায় আমি কায়দা করে এক বাড়িয়ে আমার রোল তিন করে নিয়েছিলাম!
এ তো গেল পড়ার কথা, পড়িয়েছেন যারা তাদের গল্প গল্প তো আরও বর্ণিল। ছোট থেকে বড় হওয়া অব্দি পড়েছি কত শিক্ষকের কাছে। নরম-গরম-মিঠে-কড়া নানা রুচির সেইসব মানুষেরা ধীরে ধীরে গড়ে তুলেছেন আমাদের। রক্তের মাঝে মিশিয়েছেন আদর্শের পাঠ, কানে দিয়েছেন সভ্যতার মন্ত্র, জাগিয়েছেন মানবের মাঝে বাঁচিবারে চাওয়ার স্বপ্ন। পরীক্ষার ফল নয় বাস্তবে বড় মানুষ হওয়া, অহংকারের দৃপ্তি নয় বিনয়ে অবনত হওয়া এসব শিক্ষায় গড়ে তোলা মানুষদের এই শিক্ষক দিবসে প্রণত শ্রদ্ধা। বিদ্যালয়ের বিভা, জ্ঞানের উৎস, আদর্শের বাতিঘর সেই শিক্ষকরা বেঁচে থাকুন তাদের কাজে-প্রজ্ঞায়। বেঁচে থাকুন আজ, বেঁচে থাকুন চিরকাল!