স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের উত্তাল সময়। ১৯৮৭ সালের ৪ নভেম্বর। চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক লালদিঘী ময়দানে বিএনপির জনসভার দিন। বিকেলে ওই সমাবেশে বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বক্তব্য দেওয়ার কথা ছিল। সেই সময় স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনে দেশের মানুষের কাছে আপোষহীন ও বিশ্বাসযোগ্য নেত্রী হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন খালেদা জিয়া।
ঘোষণা অনুযায়ী ওই দিন সকালে দলের ভাইস চেয়ারম্যান ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীর সঙ্গে প্রথম ফ্লাইটে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম আসার কথা ছিল বিএনপি চেয়ারপারসনের। তবে বেগম খালেদা জিয়াকে চট্টগ্রামে পৌঁছাতে না দেওয়ার জন্য নানা বাধা সৃষ্টি করে তৎকালীন স্বৈরাচারী সরকার। শেষ পর্যন্ত ঢাকা থেকে ফাস্ট ফ্লাইটে তাঁর চট্টগ্রাম যাত্রা আটকে দেওয়া হয়। যদিও একই বিমানে ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী চট্টগ্রামে পৌঁছাতে সক্ষম হন।
এদিকে বেগম খালেদা জিয়াকে অভ্যর্থনা জানাতে সকাল থেকেই বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী চট্টগ্রাম বিমানবন্দরের বাইরে অবস্থান করছিলেন। যখন তারা জানতে পারেন, বিএনপি চেয়ারপারসনকে চট্টগ্রাম আসতে দেওয়া হচ্ছে না, তখন বিমানবন্দরের বাইরে বিক্ষোভ শুরু হয়। ওই বিক্ষোভের নেতৃত্ব দেন তৎকালীন চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক একরামুল করিম।
সেই সময়কার ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক কে এম ফেরদৌস কালের কণ্ঠকে জানান, কীভাবে বেগম খালেদা জিয়া ‘দেশনেত্রী’ উপাধিতে ভূষিত হন। তিনি বলেন, ১৯৮৭ সালের ৪ নভেম্বর সকালে বিএনপি চেয়ারপারসন চট্টগ্রামে আসতে না পারার খবরে বিক্ষোভ আরও তীব্র হয়। যদিও ভাইস চেয়ারম্যান ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী ঠিকই চট্টগ্রামে পৌঁছান।
ওই সময় চট্টগ্রামের অনেক সিনিয়র বিএনপি নেতার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি ছিল। অনেকেই গ্রেপ্তার এড়াতে আত্মগোপনে ছিলেন। তাদের মধ্যে চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সভাপতি আবদুল্লাহ আল নোমান ছিলেন অন্যতম। বিমানবন্দরে ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে অভ্যর্থনা জানাতে উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক কে এম ফেরদৌস, উত্তর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক গোলাম আকবর খন্দকার এবং বোয়ালখলী থেকে নির্বাচিত সাবেক এমপি ও বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সিরাজুল ইসলাম।
চট্টগ্রাম বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে অপেক্ষারত অবস্থায় তখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি বেগম খালেদা জিয়া চট্টগ্রামে আসতে পারবেন কিনা। তিনি তখন ঢাকা বিমানবন্দরে অপেক্ষায় ছিলেন। মোবাইল ফোনের যুগ না থাকায় বিমানবন্দরের কর্মকর্তাদের মাধ্যমে ঢাকার খোঁজ নেওয়া হচ্ছিল।
এই অপেক্ষার ফাঁকে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার সময় ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী চট্টগ্রামের নেতাদের উদ্দেশে একটি প্রস্তাব দেন। তিনি বলেন, যেহেতু চট্টগ্রাম ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনসহ বহু ঐতিহাসিক আন্দোলন-সংগ্রামের সূতিকাগার, শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এই চট্টগ্রাম থেকেই স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন এবং ১৯৬৬ সালে লালদিঘীর মাঠ থেকেই শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা ঘোষণা করেছিলেন—তাই বেগম খালেদা জিয়াকে চট্টগ্রাম থেকে একটি বিশেষ উপহার দেওয়া যেতে পারে।
এরপর তিনি প্রস্তাব দেন, স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনে বিএনপি চেয়ারপারসনের আপোষহীন ভূমিকার স্বীকৃতি হিসেবে তাঁকে লালদিঘীর মাঠে ‘দেশনেত্রী’ উপাধিতে ভূষিত করা হোক। ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী বলেন, ১৯৮৬ সালে এই লালদিঘীর মাঠেই পনেরো দলীয় জোটের সমাবেশে জোটনেত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দিয়েছিলেন, স্বৈরাচার এরশাদের অধীনে যারা তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেবে, তারা জাতীয় বেইমান হিসেবে চিহ্নিত হবে। কিন্তু ওই সমাবেশ শেষে ঢাকায় ফিরে রাতেই তিনি নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দেন। এর প্রতিবাদ করেছিলেন বেগম খালেদা জিয়া।
ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীর এই প্রস্তাবের পর বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে কাগজ না পেয়ে একটি সিগারেটের প্যাকেটেই কে এম ফেরদৌস প্রথমে ‘দেশনেত্রী’ উপাধির খসড়া অভিনন্দনপত্র তৈরি করেন। পরে ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী সেটি দেখে সামান্য সংশোধন করেন। এরপর তৎকালীন চট্টগ্রাম উত্তর জেলা ছাত্রদলের সভাপতি নুরুল আমিনকে নগরীর হাজারীগলির ফটোবাইন্ডিংয়ের দোকানে পাঠিয়ে আনুষ্ঠানিক অভিনন্দনপত্র প্রস্তুত করানো হয়। প্রয়োজনীয় খরচ দেন উত্তর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক গোলাম আকবর খন্দকার।
১৯৮৬ সালের তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর এই জনসভাই ছিল চট্টগ্রামে বেগম খালেদা জিয়ার প্রথম বড় সমাবেশ। নির্বাচনের পর থেকে তাঁর আপোষহীন আন্দোলনে স্বৈরশাসক এরশাদ দিশেহারা হয়ে পড়েন। সকালে ফাস্ট ফ্লাইটে তাঁকে চট্টগ্রাম আসতে বাধা দেওয়া হলেও শেষ পর্যন্ত দুপুরের দিকে তিনি বিমানে করেই চট্টগ্রামে পৌঁছান।
দুপুর থেকেই লালদিঘীর ময়দান জনসমুদ্রে পরিণত হয়। আত্মগোপনে থাকা সত্ত্বেও চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সভাপতি আবদুল্লাহ আল নোমান সমাবেশে উপস্থিত হন, যা নেতাকর্মীদের মধ্যে নতুন উদ্দীপনা সৃষ্টি করে। সমাবেশে বেগম খালেদা জিয়ার পাশাপাশি ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীসহ একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা উপস্থিত ছিলেন।
লালদিঘীর বিশাল জনসমাবেশে লাখো মানুষের সামনে সভাপতি আবদুল্লাহ আল নোমান যখন বেগম খালেদা জিয়ার উদ্দেশে প্রস্তুত করা ‘দেশনেত্রী’ উপাধির ঐতিহাসিক মানপত্র পাঠ করেন, তখন মূহুর্মূহু করতালি ও স্লোগানে মাঠ প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। এরপর সেই অভিনন্দনপত্র বিএনপি চেয়ারপারসনের হাতে তুলে দেওয়া হয়।
এই ঘটনাটির মধ্য দিয়েই বেগম খালেদা জিয়া ‘দেশনেত্রী’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। এরপর দেশ-বিদেশের গণমাধ্যমেও তিনি এই উপাধিতে পরিচিত হতে থাকেন। বীরপ্রসবিনী চট্টগ্রামের জনগণের পক্ষ থেকে দেওয়া ‘দেশনেত্রী’ উপাধির মর্যাদা তিনি আমৃত্যু সম্মানের সঙ্গে বহন করেছেন।
সিএ/এএ


