বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের সময় বেগম খালেদা জিয়ার বয়স ছিল ৩৬ বছর। তখন তিনি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না; ছিলেন একজন সাধারণ গৃহবধূ। স্বামীর হত্যাকাণ্ডের পরই রাজনীতিতে যুক্ত হন তিনি। যোগ দেওয়ার আড়াই বছরের মধ্যেই বিএনপির সর্বোচ্চ নেতৃত্বে উঠে আসেন খালেদা জিয়া।
১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি তিনি বিএনপির প্রাথমিক সদস্যপদ গ্রহণ করেন। ১৯৮৩ সালের মার্চে হন দলের জ্যেষ্ঠ ভাইস চেয়ারম্যান। বিচারপতি আব্দুস সাত্তার অসুস্থ হয়ে পড়লে ১৯৮৪ সালের ১২ জানুয়ারি তাকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন করা হয়। একই বছরের ১০ মে কাউন্সিলের মাধ্যমে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তিনি দলের চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন।
এর পর থেকে মৃত্যুর দিন পর্যন্ত টানা ৪১ বছরের বেশি সময় বিএনপির চেয়ারপারসন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন খালেদা জিয়া। তার নেতৃত্বে বিএনপি তিনবার রাষ্ট্রক্ষমতায় যায়। ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে যথাক্রমে পঞ্চম, ষষ্ঠ ও অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী হন।
রাজনৈতিক জীবনে খালেদা জিয়া ব্যক্তিগতভাবে কখনো কোনো নির্বাচনে পরাজিত হননি। পাঁচটি সংসদ নির্বাচনে ২৩টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে প্রতিটি আসনেই তিনি বিজয়ী হন—যা বাংলাদেশের নির্বাচনী ইতিহাসে এক অনন্য রেকর্ড।
দলের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই নানা প্রতিকূলতার মুখে পড়েন খালেদা জিয়া। সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে বিএনপিকে ঐক্যবদ্ধ করে আপসহীন আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন তিনি। কোনো ধরনের সমঝোতা না করেই ‘এরশাদ হটাও’ আন্দোলন জোরদার করেন। দীর্ঘ আন্দোলনের পর ১৯৯০ সালে এরশাদের পতন ঘটে এবং ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠন করে।
খালেদা জিয়া ১৯৯১ সালে প্রথমবার, ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয়বার এবং ২০০১ সালে জোটগতভাবে তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন। তিনি দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক)-এর চেয়ারপারসনের দায়িত্বও দুবার পালন করেন।
২০০৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের (ওয়ান-ইলেভেন) সময় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। দীর্ঘদিন কারাবাসের পর আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে তিনি জামিনে মুক্তি পান। কারাবন্দি অবস্থায় তাকে বিদেশে নির্বাসনে পাঠানোর চেষ্টা হলেও তিনি দেশ ছাড়তে অস্বীকার করেন।
আওয়ামী লীগ সরকার আমলে ২০১০ সালের ১৩ নভেম্বর খালেদা জিয়াকে ক্যান্টনমেন্টের বাসভবন থেকে উচ্ছেদ করা হয়। ওই বাড়িতে তিনি ২৮ বছর বসবাস করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে তার বিরুদ্ধে ৩৭টি মামলা করা হয়। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় সাজা হয় তার। পরে নির্বাহী আদেশে সাজা মওকুফ করা হয় এবং জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় তিনি খালাস পান।
কারাবন্দি অবস্থায় তাকে ধীরে ধীরে বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়ার অভিযোগও করেছে বিএনপি। গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার আবেদন বারবার করা হলেও তা অনুমোদন দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ দলের নেতাদের।
স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ‘আপসহীন নেত্রী’ হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠা খালেদা জিয়া জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত দলীয় নেতৃত্বে ছিলেন। গৃহবধূ থেকে রাষ্ট্রনায়ক—চার দশকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে তার উপস্থিতি বিএনপির ইতিহাসে এক অনন্য অধ্যায় হয়ে থাকবে।
সিএ/এএ


