ইস্পাহানি-প্রথম আলো তৃতীয় আন্তবিশ্ববিদ্যালয় ফুটবলে সেরা খেলোয়াড়—এই পরিচয়ই রাফায়েল টুডুকে এনে দিয়েছে আলোচনার কেন্দ্রে। রানার্সআপ গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্সিতে পাঁচ ম্যাচে আট গোল করেছেন তিনি। গ্রুপ পর্বের ফাইনাল ও কোয়ার্টার ফাইনালে করেছেন হ্যাটট্রিক, সেমিফাইনালে জোড়া গোল। পুরো টুর্নামেন্টে সর্বোচ্চ গোলদাতা হওয়ার পাশাপাশি জিতেছেন সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কারও। ২৫ বছর বয়সী এই স্ট্রাইকার বর্তমানে খেলছেন ঢাকা মোহামেডানের হয়ে। তাঁর আগুনঝরা নৈপুণ্য দেশের ফুটবলে যেন নতুন সম্ভাবনার আলো জ্বালিয়েছে।
এই আলো রাফায়েলকে ফিরিয়ে নেয় তাঁর শুরুর দিনে, রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার ছোট্ট গ্রাম আমতলীপাড়ায়। সাঁওতাল সম্প্রদায়ের এই গ্রামে অধিকাংশ মানুষ কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত। সেখানেই জন্ম রাফায়েল টুডুর। বাবা মানিক টুডু ছিলেন কৃষক। চার ভাই ও দুই বোন নিয়ে আট সদস্যের পরিবারে জীবন চলত সীমাহীন সংগ্রামের ভেতর দিয়ে। সেই পরিবেশে ফুটবল খেলা অনেকের চোখে ছিল বিলাসিতা।
তবু ছোটবেলাতেই বাবার হাত ধরেই ফুটবলের সঙ্গে পরিচয় রাফায়েলের। একদিন অসুস্থ বাবাকে বাড়িতে রেখে অনুশীলনে গিয়েছিলেন তিনি। সাইকেলে ফিরে এসে দেখেন, বাবা আর নেই। ২০১৭ সালে বাবার শেষ বিদায়ে পাশে থাকতে না পারার বেদনা আজও তাড়া করে বেড়ায় তাঁকে।
২০১৯ সালে রাজশাহীর কিশোর ফুটবল একাডেমিতে ভর্তি হন রাফায়েল। শারীরিক গড়ন দেখে কোচ প্রথমে তাঁকে গোলকিপার হিসেবে ভাবেন। শুরুটাও হয় সেই অবস্থানেই। সে বছরই মাত্র ৭০০ টাকা নিয়ে একরাতে ট্রেনে চেপে ঢাকায় আসেন তিনি, চোখে পেশাদার ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন। লক্ষ্য ছিল বিসিএল, দেশের ফুটবলের দ্বিতীয় স্তর।

২০২০-২১ মৌসুমে বিসিএলে ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিংয়ের হয়ে গোলকিপার হিসেবে তিনটি ম্যাচ খেলেন রাফায়েল। ফলাফল ছিল দুই হার ও এক ড্র। নিয়মিত সুযোগ না পেয়ে ২০২২ সালে রাজশাহীতে ফিরে গিয়ে আবার খেলতে শুরু করেন স্ট্রাইকার হিসেবে। তাঁর মনে হয়েছিল, গোলকিপার হিসেবে এগোনো কঠিন হবে। লিওনেল মেসিকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে আক্রমণভাগে নিজেকে নতুনভাবে গড়ে তোলেন তিনি।
এ বছর মার্চে খেলোয়াড় কোটায় বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে চাকরি পান রাফায়েল। এরপর সুযোগ আসে বাংলাদেশ লিগের ক্লাব ফকিরেরপুল ইয়াংমেনসে। শুরুতে ইয়াংমেনসের জার্সিতে প্রথম পাঁচ ম্যাচে এক মিনিটও মাঠে নামতে পারেননি। তবে ষষ্ঠ ম্যাচে উত্তরা এফসির বিপক্ষে কোচ তাঁকে নামানোর পরই বদলে যায় দৃশ্যপট। সেই ম্যাচে চার গোল করে জানান দেন নিজের সামর্থ্যের। এরপর ৯ ম্যাচে ১২ গোল করে লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতা হন এবং জেতেন লিগের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার।
ইস্পাহানি-প্রথম আলোর আন্তবিশ্ববিদ্যালয় টুর্নামেন্ট রাফায়েলের পরিচিতি আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। নিজেই বলেছেন, ‘এই টুর্নামেন্ট আমাকে পরিচিতি দিয়েছে, প্রচার দিয়েছে। অনেকে আমাকে চিনেছে। এত প্রচার বিসিএলেও পাইনি।’ সেমিফাইনাল ও ফাইনালে টেলিভিশনের পর্দায় গ্রামের মানুষ তাঁর খেলা দেখেছেন, দেখেছে পরিবারও। এ নিয়ে উচ্ছ্বসিত রাফায়েল বলেন, ‘প্রথম আলোয় ছাপা হওয়া আমার ছবি কেউ কেউ আমাকে পাঠান। সবাই খুব খুশি আমাকে নিয়ে।’
মা মাকলু হেমব্রম এখনো থাকেন মাটির ঘরে। বাড়িতে নেই টেলিভিশন। পাড়ার মানুষের কাছ থেকে এখন তিনি পাচ্ছেন অভিনন্দন। রাফায়েলের ইচ্ছা, শিগগিরই একটি টিভি কিনবেন মায়ের জন্য। বড়দিনের আগে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জানান, টুর্নামেন্টে পাওয়া ২০ হাজার টাকার অর্থ পুরস্কার তিনি মা ও পরিবারের সদস্যদের বড়দিনের উপহার কেনার জন্য পাঠাবেন। ক্লাবের খেলা থাকায় নিজে বাড়িতে যেতে পারবেন না।
২০২১ সালে উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পর পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছিলেন রাফায়েল। পরে এলাকার এক বড় ভাইয়ের পরামর্শে গত বছর গণ বিশ্ববিদ্যালয়ে খেলোয়াড় কোটায় ভর্তি হন, সমাজবিজ্ঞান বিভাগে। সেখানে ফুটবলার হিসেবে তিনি এখন উজ্জ্বল মুখ। একসময় গ্রামে শোনা যেত, ‘ফুটবল খেললে কী হবে, শেষে কৃষিকাজই করতে হবে।’ আজ সেই সাঁওতাল সম্প্রদায়ই তাঁকে নিয়ে গর্বিত।
রাফায়েলের পথচলায় একা নন তিনি। পাশের পাথরঘাটা গ্রামের শান্ত টুডু ও টেমা গ্রামের শিবলাল টুডুও উঠে এসেছেন দেশের শীর্ষ ফুটবলে। তিনজনই গত মৌসুমে ফকিরেরপুল ইয়াংমেনসের হয়ে দেশের শীর্ষ লিগে খেলেছেন। শান্ত ও শিবলালও কৃষক পরিবারের সন্তান।
ধানখেত থেকে ঢাকা মোহামেডান পর্যন্ত রাফায়েলের এই যাত্রা পরিশ্রম ও ভাগ্যের মিশেলে গড়া। সামনে তাঁর স্বপ্ন আরও বড়। তিনি বলেন, ‘জাতীয় দলে খেলার সুযোগের অপেক্ষায় আছি। বাংলাদেশ জাতীয় দলে অনেক দিন ধরে নাম্বার নাইন নেই। আমি চাই, সেই অভাব পূরণ করতে।’
সিএ/বিই


