বিশ্বজুড়ে জনসংখ্যা এখনও বাড়ছে, তবে জন্মহার কমছে দ্রুতগতিতে। এর ফলে বহু বিশেষজ্ঞ ভবিষ্যতে জনসংখ্যা হ্রাসকে মানবসভ্যতার জন্য বড় হুমকি হিসেবে দেখছেন। কেউ কেউ আবার আশ্বস্ত করছেন—এ নিয়ে অত আতঙ্কের কিছু নেই।
জনসংখ্যা বিস্ফোরণের ভবিষ্যদ্বাণী, এখন উল্টো ভয়
১৯৬৮ সালে প্রকাশিত দ্য পপুলেশন বম্ব বইতে জীববিজ্ঞানী পল আরলিশ ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, মানুষের অতিদ্রুত বংশবিস্তার খাদ্য সংকট ডেকে আনবে এবং ‘শত শত কোটি’ মানুষ অনাহারে মারা পড়বে। তিনি এমনকি বাড়তি মানুষকে মহাকাশে পাঠানোর প্রস্তাব দিয়েছিলেন এবং প্রয়োজনে জোরপূর্বক জন্মনিয়ন্ত্রণের পক্ষেও মত দিয়েছিলেন।
তবে সেই ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তবে ঘটেনি। বরং এখন ধনী দেশগুলোতে উল্টো ভয়—জনসংখ্যা দ্রুত কমে যাচ্ছে। বহু সন্তানের জনক ইলন মাস্ক পর্যন্ত ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, “নিম্ন জন্মহারই সভ্যতার পতন ঘটাবে।”
জন্মহার নিচে নামছে প্রতিস্থাপন হারের
বর্তমানে নারীরা জীবনে গড়ে যত সন্তান জন্ম দেন, তার হার দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। শুধু ধনী দেশেই নয়, এখন বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ এমন দেশে বাস করছে যেখানে জন্মহার ‘প্রতিস্থাপন হার’ ২.১-এর নিচে।
জনসংখ্যা স্থিতিশীল রাখতে নারীর গড় প্রজনন হার হওয়া উচিত ২.১। কিন্তু উদাহরণস্বরূপ, কলম্বিয়ার বোগোটায় এখন জন্মহার মাত্র ০.৯১, যা টোকিওর ০.৯৯-এর চেয়েও কম।
জাতিসংঘের হিসাবে, বিশ্বের জনসংখ্যা সর্বোচ্চ ১,০৩০ কোটিতে পৌঁছাবে ২০৮৪ সালে। তবে অনেক গবেষক এই হিসাব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁদের মতে, যদি বর্তমান প্রবণতা আরও ১০ বছর স্থায়ী হয়, তবে জনসংখ্যা ২০৬৫ সালেই সর্বোচ্চ ৯৬০ কোটিতে পৌঁছাবে এবং ২১০০ সালে কমে দাঁড়াবে ৮৯০ কোটিতে।
জনসংখ্যা হ্রাসের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ভয়
জন্মহার প্রতিস্থাপন হারের নিচে নেমে যাওয়ার মানে হলো—প্রথমে ধীরে ধীরে, পরে হঠাৎ করেই জনসংখ্যা কমতে শুরু করবে। যেমন একসময় দ্রুত বেড়ে ১৮০০ সালের ১০ কোটি থেকে আজকের ৮০০ কোটিতে পৌঁছেছিল, এবার তেমনি দ্রুত কমার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
মানুষের সংখ্যা কমলে মেধার ভাণ্ডার ছোট হবে, উদ্ভাবনের গতি শ্লথ হবে এবং বিশেষায়ন ও শ্রমবিভাজনের সুযোগও সীমিত হয়ে যাবে। কোনো শহরে যদি মাত্র এক হাজার মানুষ থাকে, তবে সেখানে বৈচিত্র্যময় খাবার বা সংস্কৃতি খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে।
দ্রুত জনসংখ্যা হ্রাস অর্থনীতিতে বড় ধাক্কা আনতে পারে। সরকারি ঋণের বোঝা তখন কম সংখ্যক, প্রায়শই বয়স্ক মানুষের কাঁধে এসে পড়বে। বড় শহরগুলো হয়তো টিকে যাবে, কিন্তু ছোট শহরগুলো জনশূন্য হয়ে পড়তে পারে।
আরেক ধরনের ভয় আরও সংকীর্ণ ও জাতীয়তাবাদী। জন্মহার দেশ ও জনগোষ্ঠীভেদে ভিন্ন। কেউ কেউ আশঙ্কা করেন, ভবিষ্যতে ‘নিজেদের মতো’ মানুষের সংখ্যা কমে যাবে, আর ‘সংস্কৃতিগতভাবে ভিন্ন’ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বেড়ে যাবে। এ কারণেই পশ্চিমা বিশ্বের অনেক জনতাবাদী নেতা পরিবারগুলোকে বেশি সন্তান নেওয়ার জন্য প্রণোদনা দিচ্ছেন। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এমনকি নিজেকে ‘ফার্টিলাইজেশন প্রেসিডেন্ট’ বানানোর প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন।
আশার দিকও আছে
তবে সব বিশেষজ্ঞই এই সম্ভাবনাকে ধ্বংসের পূর্বাভাস হিসেবে দেখেন না।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসহ নতুন প্রযুক্তির উন্নয়ন জনসংখ্যা হ্রাসের প্রভাব অনেকটাই কাটিয়ে দিতে পারে। মানবজীবনের গড় আয়ুও বাড়ছে—৪১টি দেশের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে ৭০ বছরের মানুষের মানসিক ক্ষমতা ছিল ২০০০ সালের ৫৩ বছরের মানুষের সমান। এর ফলে মানুষ দীর্ঘ সময় কর্মক্ষম থাকতে পারছে, যা শ্রমবাজার সংকোচনের ধাক্কা সামলে দিতে পারে।
এ ছাড়া যেসব দেশ মানবসম্পদ নষ্ট করছে, তারা হয়তো শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং নারীদের কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণ বাড়িয়ে তা কাটিয়ে উঠতে পারবে।
জাপানের উদাহরণ
জাপানের জনসংখ্যা প্রায় দুই দশক ধরে হ্রাস পাচ্ছে। তবুও দেশটির জীবনমান উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত হয়েছে, যা প্রমাণ করে জনসংখ্যা কমলেও দারিদ্র্য অনিবার্য নয় এবং প্রযুক্তি ও মানবসম্পদের সঠিক ব্যবহার দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব।