যুক্তরাষ্ট্রের উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএআইডি (USAID) থেকে অনুদান কমলেও বাংলাদেশে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর (এনজিও) জন্য বিদেশি অনুদান ২০২৪-২৫ অর্থবছরে রেকর্ড ৯,২২০ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর তহবিল ছাড়ের প্রক্রিয়া সহজ হওয়া এবং টাকার অবমূল্যায়নের ফলে ডলারে প্রাপ্ত অর্থের স্থানীয় মূল্য বেড়ে যাওয়াকে এই প্রবৃদ্ধির পেছনের মূল কারণ হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।
অনুদান প্রবাহে রেকর্ড বৃদ্ধি
গত কয়েক বছর তুলনামূলক স্থবির থাকার পর ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এনজিও খাতে বিদেশি অনুদান ছিল ৭,৬০১ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে সেটি ২১ শতাংশ বেড়ে ৯,২২০ কোটিতে পৌঁছেছে বলে জানিয়েছে এনজিও বিষয়ক ব্যুরো (NGO Affairs Bureau)।
ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রতিশ্রুত ৯,২০৬ কোটির বেশি অনুদান এসেছে, যেখানে আগের অর্থবছরে (২০২৩-২৪) প্রতিশ্রুত ৯,৭৫৪ কোটির বিপরীতে পাওয়া গিয়েছিল ৭,৬০১ কোটি টাকা।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন,
“টাকার বিপরীতে ডলারের মান বৃদ্ধির ফলে একই পরিমাণ বৈদেশিক অর্থ এখন বেশি টাকায় পরিণত হচ্ছে, এটি অনুদানের পরিমাণ বৃদ্ধির একটি বাস্তব কারণ হতে পারে। একই সঙ্গে বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দাতারা নতুন আস্থার পরিবেশে অনুদান দিতে আগ্রহী হচ্ছেন।”
তিনি আরও বলেন,
“পূর্ববর্তী সরকারের আমলে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও সুশাসন খাতে অনুদান পেতে এনজিওগুলোকে নানা সমস্যায় পড়তে হতো। বর্তমান সরকারের অধীনে এসব খাতে কাজের সুযোগ তৈরি হওয়ায় অনেক দাতা সংস্থা পুনরায় সক্রিয় হয়েছে।”
রাজনৈতিক পট পরিবর্তন ও দাতাদের আস্থা
২০২৪ সালের আগস্টে রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকারের প্রতি দাতাদের আস্থা বেড়েছে। তাদের বিশ্বাস, এই সরকারের অধীনে অনুদান আরও কার্যকরভাবে বাংলাদেশের সামাজিক-অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যবহার হবে।
স্থানীয় এনজিওগুলোর মতে, আগের সরকারের আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে তহবিল ছাড়ে বিলম্ব হতো, যা এখন সহজ হওয়ায় অনুদান প্রবাহ বাড়ছে।
ইউএসএআইডির অনুদান কমার প্রভাব
এদিকে ইউএসএআইডি তহবিল কমানোয় গত দুই বছরে এনজিও খাতে হাজারো চাকরি হারানোর ঘটনা ঘটেছে। এনজিও বিষয়ক ব্যুরো ইতোমধ্যে নতুন প্রকল্পে নিয়োগের সময় এসব ছাঁটাই হওয়া কর্মীদের অগ্রাধিকার দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
ব্যুরোর পরিচালক (প্রকল্প–১ ও ২) মো. আনোয়ার হোসেন বলেন,
“ইউএসএআইডি জানুয়ারি থেকে ফান্ড কাটার ঘোষণা দিয়েছে। এর প্রভাব ২০২৪-২৫ অর্থবছরে পুরোপুরি পড়েনি, কারণ তখনও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ পাওয়া গিয়েছিল। তবে ২০২৫-২৬ অর্থবছর থেকে এর প্রভাব স্পষ্ট হবে।”
তিনি আরও জানান,
“ইউএসএআইডি তহবিল কমানোর পর এনজিওগুলো বিকল্প উৎস থেকে তহবিল সংগ্রহে মনোনিবেশ করেছে, বিশেষত ইউরোপের দেশগুলো এবং যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ফাউন্ডেশনগুলো থেকে। ফলে পরিস্থিতি কিছুটা হলেও স্থিতিশীল হয়েছে।”
খাতভিত্তিক বরাদ্দ: স্বাস্থ্য ও শিক্ষাখাতে শীর্ষ অবস্থান
২০২৪-২৫ অর্থবছরে এনজিও খাতে প্রাপ্ত অনুদানের বড় অংশ গেছে স্বাস্থ্য ও শিক্ষাখাতে।
- স্বাস্থ্য: ২,৭২৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা
- শিক্ষা: ১,২৬৯ কোটি টাকা
- সামাজিক উন্নয়ন: ৭৫০ কোটি টাকা
- ত্রাণ ও পুনর্বাসন: ৭১১ কোটি টাকা
- দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা: ৫৪৪ কোটি টাকা
- পানি ও স্যানিটেশন: ৪২২ কোটি টাকা
- নারীর উন্নয়ন: ৩০২ কোটি টাকা
- স্থানীয় সরকার: ২৩১ কোটি টাকা
- পরিবেশ: ২২৫ কোটি টাকা
- কৃষি: ২০২ কোটি টাকা
শুধু গত বছরেই শিক্ষা খাতে ৫৩৮ কোটি টাকা এবং স্বাস্থ্য খাতে ৫৩১ কোটি টাকা অতিরিক্ত বরাদ্দ এসেছে।
সিপিডির খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেমের মতে,
“এনজিও খাত সরাসরি কর্মসংস্থান সৃষ্টি না করলেও স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা ও সামাজিক খাতে সহায়ক পরিবেশ তৈরি করে। অনেক সময় এনজিও নিজেরা প্রকল্প বাস্তবায়ন না করে স্বাস্থ্যসেবা খাতে কাজ করা সংগঠনগুলোর সঙ্গে অংশীদারিত্ব করে।”
তিনি আরও বলেন,
“এনজিও খাতে বহুমাত্রিক মনিটরিং ব্যবস্থার কারণে অনুদানের অর্থনৈতিক প্রভাব তুলনামূলক বেশি হয় এবং সুবিধাভোগীরা সরাসরি এর সুফল পান।”
ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ
বিশ্লেষকরা বলছেন, এনজিও খাতে অনুদান বৃদ্ধির এই ধারা টেকসই করতে হলে বহুমুখী তহবিল উৎস গড়ে তোলা এবং দক্ষ মানবসম্পদ ধরে রাখার ওপর জোর দিতে হবে। ইউএসএআইডি তহবিলের ঘাটতি পূরণে ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার নতুন দাতা সংস্থাগুলোর সঙ্গে অংশীদারিত্ব গড়ে তোলারও পরামর্শ দিয়েছেন তারা।