ফুলের প্রতি মানুষের ভালোবাসা চিরন্তন। কিন্তু ছাতিম ফুলের ঘ্রাণ যেন প্রকৃতির নিজস্ব এক জাদু। হেমন্তের আগমনী বার্তা নিয়ে ছাতিম ফুল যখন ফোটে, তখন তার মিষ্টি ও মোহনীয় ঘ্রাণে যেন চারপাশের বাতাসও অন্যরকম হয়ে ওঠে। কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়ায় এখন এই ফুলের সুবাসে ভরে উঠেছে গ্রামাঞ্চলের প্রতিটি প্রান্ত, আকৃষ্ট করছে পথচারী থেকে প্রকৃতিপ্রেমী সব মানুষকে।
দিনের আলোয় চোখে পড়া কঠিন হলেও সন্ধ্যা নামলেই ছাতিম ফুল তার তীব্র ঘ্রাণে জানান দেয়, প্রকৃতিতে হেমন্ত এসে গেছে। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এর গন্ধ আরও মাদকীয় হয়ে ওঠে। বিশেষ করে গ্রামের নিস্তব্ধ রাতগুলোতে এই ফুলের সুবাস বাতাসে ভেসে বেড়ায়, যেন প্রকৃতি নিজেই কোনো অদৃশ্য সুগন্ধের চাদরে মোড়া।
ঔষধি গুণে অনন্য ছাতিম
ইউনানি চিকিৎসকদের মতে, ছাতিম শুধু প্রকৃতিকে সুগন্ধিত করে না, এর প্রতিটি অংশেই আছে অসাধারণ ভেষজ গুণ। গাছের বাকল, পাতা ও কষ ব্যবহার করা হয় জ্বর, দীর্ঘস্থায়ী পাতলা পায়খানা, আমাশয়, চর্মরোগ, রক্তচাপ কমানোসহ নানা রোগ নিরাময়ে। এমনকি এর ছাল থেকে তৈরি ক্বাথ ম্যালেরিয়া ও টাইফয়েডের মতো জ্বরের প্রতিরোধে কার্যকর বলে পরিচিত।
উদ্ভিদ পরিচিতি ও বৈশিষ্ট্য
ছাতিম গাছের বৈজ্ঞানিক নাম Alstonia scholaris—এটি অ্যাপোসাইনেসি পরিবারের অন্তর্ভুক্ত একধরনের বহুবর্ষজীবী সপুষ্পক উদ্ভিদ। ইংরেজিতে একে ‘ডেভিলস ট্রি’ বা ‘ব্ল্যাকবোর্ড ট্রি’ বলা হয়। ভারতের উপমহাদেশ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াই এর আদি নিবাস। গাছটি সাধারণত ২০ থেকে ৪০ মিটার পর্যন্ত উঁচু হয়, পাতা ১০ থেকে ১৫ সেন্টিমিটার লম্বা, উপরের দিক চকচকে ও নিচে ধূসর বর্ণের। ফুলগুলো হালকা ঘিয়ে রঙের এবং গুচ্ছ আকারে ফোটে।
ছাতিমগাছের কাঠ ব্যবহৃত হয় ব্ল্যাকবোর্ড, পেনসিল ও এমনকি কফিন তৈরিতে। এটি পরিবেশবান্ধব ও বায়ু পরিশোধনে সহায়ক। পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য উদ্ভিদ হিসেবেও এটি স্বীকৃত। তবে দুঃখজনকভাবে, এ গাছের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে, যা শুধু প্রাকৃতিক ভারসাম্যের জন্য নয়, ভেষজ চিকিৎসা ব্যবস্থার জন্যও এক উদ্বেগজনক সংকেত।
প্রকৃতি ও মানুষের মুগ্ধতা
স্থানীয় বাসিন্দা আশিকুর রহমান জানান, কুমিল্লা থেকে ব্রাহ্মণপাড়া যাওয়ার পথে ছাতিমগাছের দেখা মেলে। সন্ধ্যার পর গাছগুলোর ফুলের গন্ধে মন ভরে যায়। অতীতে এলাকায় অসংখ্য ছাতিমগাছ থাকলেও এখন আর আগের মতো দেখা যায় না।
অন্যদিকে শিক্ষার্থী ফারিয়া বিনতে আবিদা বলেন, “আমাদের বাড়ির পেছনে পুকুরপাড়ে একটি ছাতিমগাছ আছে। ফুল ফুটলেই সেই ঘ্রাণ পুরো এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। প্রতিবছর এই ঘ্রাণের অপেক্ষায় থাকি।”
শিক্ষক হুমায়ুন কবিরের মতে, “ছাতিম ফুলের ঘ্রাণ মানুষকে অন্যরকম এক প্রশান্তি দেয়। ফুলটি দূর থেকে দেখা না গেলেও তার ঘ্রাণে মন হারিয়ে যায়।”
ইউনানি চিকিৎসক ডা. সোহেল রানা কালবেলা জানান, “ছাতিম ফুলের ঘ্রাণ এত তীব্র যে, সন্ধ্যার পর আশেপাশে গাছ না দেখলেও বোঝা যায় কোথাও ছাতিম ফুটেছে। এ ফুল শুধু ঘ্রাণেই নয়, ওষধি গুণেও অসাধারণ। কিন্তু দিন দিন এই গাছের সংখ্যা কমে যাচ্ছে, যা প্রকৃতির জন্য দুঃখজনক।”
ছাতিম ফুলের এই অনন্য ঘ্রাণ আমাদের মনে করিয়ে দেয়—প্রকৃতির সৌন্দর্য শুধু দৃশ্য নয়, ঘ্রাণেও ছড়িয়ে থাকে। আর সেই ঘ্রাণেই মিশে থাকে স্মৃতি, ঋতু আর জীবনের গভীর মুগ্ধতা।
সিএ/এমআর