Home ফিচার আজ “পানিতে ডুবে মৃত্যু পরিহার দিবস” আর একটি শিশুর প্রাণও যেন হারিয়ে...

আজ “পানিতে ডুবে মৃত্যু পরিহার দিবস” আর একটি শিশুর প্রাণও যেন হারিয়ে না যায়

0
ছবি : সংগৃহীত

বদরুল ইসলাম (বরগুনা)

আজ ২৫ জুলাই—বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আজ পালন করা হচ্ছে “পানিতে ডুবে মৃত্যু পরিহার দিবস” (World Drowning Prevention Day)। দিবসটির তাৎপর্য হয়তো অনেকেই জানেন না, কিন্তু এই একটি দিন প্রতি বছর আমাদের মনে করিয়ে দেয়—পানিতে ডুবে মৃত্যুর নির্মমতা কতটা গভীর এবং আমাদের কতটা সচেতন হওয়া প্রয়োজন।

আমার ব্যক্তিগত জীবনের এক অপূরণীয় ক্ষতি আজকের এই দিবসের সাথে অদ্ভুতভাবে মিলে যায়। আজ থেকে প্রায় ১৩ বছর আগে, মাত্র ৫ বছর বয়সে আমার প্রাণের ভাগ্নী নাবিলা মাহজাবিন রুম্মান পানিতে ডুবে মারা যায়। সেই মুহূর্তে মনে হয়েছিল, যেন সময় থেমে গেছে। একটি হাসিখুশি, প্রাণবন্ত শিশু, যে সবে স্কুলে যাওয়া শুরু করেছিল, যার কণ্ঠে সুর ছিল, চোখে স্বপ্ন ছিল—সে একটি অসতর্ক মুহূর্তে চলে গেল না-ফেরার দেশে।

সেইদিনের সেই কান্না, সেই আর্তনাদ এখনও আমাদের পরিবারের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটায়। আজ যখন পানিতে ডুবে মৃত্যুর প্রতিরোধে বিশ্বজুড়ে কর্মসূচি পালিত হচ্ছে, তখন আমি চাই, আমার ভাগ্নীর মতো আর কোনো শিশুর অকাল মৃত্যু যেন না ঘটে। চাই, আমাদের সকলের সচেতনতা আর উদ্যোগে গড়ে উঠুক একটি নিরাপদ সমাজ।

পানিতে ডুবে মৃত্যুর ভয়াবহ পরিসংখ্যান

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ২ লাখ ৩০ হাজার মানুষ পানিতে ডুবে মারা যায়। এর মধ্যে ৫৯% মৃত্যুই ঘটে এশিয়া অঞ্চলে।
বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে ১৮ হাজারের বেশি মানুষ পানিতে ডুবে মারা যায়। গবেষণা বলছে, এসব মৃত্যুর প্রায় ৮০ শতাংশই প্রতিরোধযোগ্য। সবচেয়ে ভয়াবহ তথ্য হলো, ১ থেকে ৫ বছর বয়সী শিশুদের মৃত্যুর শীর্ষ কারণগুলোর মধ্যে একটি হলো পানিতে ডুবে যাওয়া।

কেন এমনটা ঘটে?

বাংলাদেশে অধিকাংশ শিশু গ্রামীণ অঞ্চলে বসবাস করে, যেখানে বাড়ির আশেপাশে ডোবা, পুকুর, খাল কিংবা জমির গর্তে পানি জমে থাকে। একটু অজ্ঞানতাবশত, সামান্য নজরদারির অভাব কিংবা খেলতে খেলতে হঠাৎ পানির ধার ঘেঁষে গেলে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে।

অনেক ক্ষেত্রেই শিশুরা সাঁতার জানে না। আবার পরিবারে বাবা-মা কর্মব্যস্ত থাকলে শিশু একাকী খেলে, আর তখনই ঘটে বিপদ। বৃষ্টির পানি জমে থাকা ক্ষেতের পাশের গর্ত কিংবা স্লুইস গেটের পাশেও ডুবে মারা যাওয়ার ঘটনা বেড়েছে।

কীভাবে রক্ষা করা যায় আমাদের সন্তানদের?

নিরাপত্তা বলয় তৈরি করা: বাড়ির আশপাশে যেসব জায়গায় পানি থাকে, তা বাঁশ বা জাল দিয়ে ঘিরে রাখা জরুরি।

৩ বছর বয়স থেকে সাঁতার শেখানো: গবেষণা বলছে, সাঁতার জানা শিশুদের পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঝুঁকি ৮৮% কমে যায়।

চোখের আড়াল না হওয়া: অন্তত ৫ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুকে একা পানির ধার ঘেঁষে যেত দেওয়া উচিত নয়।

স্থানীয় পর্যায়ে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র: ইউনিয়ন বা ওয়ার্ড পর্যায়ে শিশু সুরক্ষায় সাঁতার শেখানোর উদ্যোগ সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে জোরদার করতে হবে।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ে “জীবন রক্ষা শিক্ষা”: শিশুদের প্রাথমিক শ্রেণি থেকেই পানি নিরাপত্তা বিষয়ে শিক্ষা দিতে হবে।

প্রত্যেক মৃত্যুর খবর গুরুত্বসহকারে তুলে ধরা: যেন পরিবার, সমাজ এবং প্রশাসনের মধ্যে দায়িত্ববোধ জাগে।

সরকারি উদ্যোগ দরকার

জাতীয় পর্যায়ে পানিতে ডুবে মৃত্যু রোধে ইতিমধ্যেই কিছু প্রকল্প চলমান, তবে তা পর্যাপ্ত নয়। এই মৃত্যু রোধে “জাতীয় সাঁতার শিক্ষা কার্যক্রম”, প্রতিটি ইউনিয়নে নিরাপদ খেলার মাঠ, অন্তত একটি সরকারি প্রশিক্ষিত উদ্ধারকারী দল থাকা জরুরি।
এছাড়া প্রতিটি জেলার স্বাস্থ্য বিভাগের অধীনে “পানিতে ডুবে প্রতিরোধ ইউনিট” গঠন করা উচিত, যারা সচেতনতামূলক প্রচার চালাবে।

নাবিলা হারিয়ে গেছে, কিন্তু…

আমার প্রিয় ভাগ্নী নাবিলা মাহজাবিন রুম্মান আর ফিরে আসবে না, কিন্তু আজ যারা বেঁচে আছে, তাদের জন্য এই দিনটিতে কিছু বলার দায়বোধ থেকেই গেল। শিশুর প্রাণ শুধু তার পরিবারের নয়—তা পুরো জাতির ভবিষ্যৎ। প্রতিটি শিশু রক্ষা পেলে দেশ রক্ষা পায়।

একটি শিশুও যেন না হারায় প্রাণ। একটি কান্নাও যেন না ভেসে আসে পানির অতল গহ্বর থেকে। আজই সময়—সচেতন হই, উদ্যোগ নেই।

পরিশেষে বলা যায়, পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধযোগ্য। একটু সতর্কতা, একটু ভালোবাসা, আর দায়িত্বশীল আচরণই পারে এক শিশুর জীবন বাঁচাতে। আসুন, আমরা সবাই মিলে গড়ি নিরাপদ এক সমাজ।

নাবিলা, তুমি ভালো থেকো ওপারে। তোমার এই চলে যাওয়া যেন আরও শত শত শিশুর জীবন রক্ষা করতে পারে—এই হোক আমাদের অঙ্গীকার।

NO COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Exit mobile version