গিয়ের্মো দেল তোরোর সিনেমায় দানব মানেই শুধু ভয়ের চরিত্র নয়; তাঁর দানবগুলো মানবিকতা, বেদনা ও আবেগে ভরপুর। বহু বছর ধরে মেরি শেলির কিংবদন্তি উপন্যাস ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন’ নিয়ে কাজ করার স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি। অবশেষে সেই স্বপ্ন বাস্তবতায় রূপ নিল—৭ নভেম্বর নেটফ্লিক্সে মুক্তি পেল দেল তোরোর নিজের ভাবনায় নতুন ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন’, যা দুই শতাব্দী পুরোনো কাহিনির প্রতি শ্রদ্ধা রেখেও এক নতুন গথিক অভিজ্ঞতা তৈরি করেছে।
এক নজরে
সিনেমা: ফ্রাঙ্কেনস্টাইন
ধরন: গথিক সায়েন্স–ফিকশন
পরিচালনা: গিয়ের্মো দেল তোরো
অভিনয়: অস্কার আইজ্যাক, জ্যাকব এলর্ডি, মিয়া গথ, ফেলিক্স কামারার, ক্রিস্টফ ওয়াল্টজ
স্ট্রিমিং: নেটফ্লিক্স
রানটাইম: ২ ঘণ্টা ৩০ মিনিট
গল্পের বিন্যাস
সিনেমাটি তিন ভাগে সাজানো—শুরুর বয়ান, ভিক্টর ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের গল্প এবং মনস্টারের বয়ান। ১৮১৮ সালের উপন্যাসের মূল কাঠামো বজায় রাখা হলেও দেল তোরোর সিনেমার সময়কাল ১৮৫৭, ভিক্টোরিয়ান যুগে স্থাপিত। ফলে গল্পটি আধুনিক দর্শকের কাছেও পরিচিত অনুভব তৈরি করে।
শুরুতে দেখা যায় আর্কটিক অঞ্চলে স্রষ্টা ও সৃষ্টি পরস্পরের পিছু ধাওয়া করছে। দেল তোরোর উপস্থাপন একদিকে ভয়াবহ, অন্যদিকে গভীরভাবে হৃদয়স্পর্শী। মনস্টারকে তিনি একধরনের অতিপ্রাকৃত সত্তা হিসেবে দেখিয়েছেন, যার বয়ান শুরু হতেই গল্প নেয় নতুন মোড়।

ভিক্টর ও তার সৃষ্টি
দুঃস্বপ্নময় শৈশবের স্মৃতি নিয়ে বড় হয় ভিক্টর (অস্কার আইজ্যাক)। মায়ের মৃত্যুর বেদনা ও বাবার (চার্লস ড্যান্স) কঠোরতা তাকে স্রষ্টার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী করে তোলে। তরুণ চিকিৎসক ভিক্টর মৃতদেহে ইলেকট্রিসিটির মাধ্যমে প্রাণ সঞ্চার করে হইচই ফেলে দেয়।
ধনকুবের অস্ত্র ব্যবসায়ী হ্যারল্যান্ডার (ক্রিস্টফ ওয়াল্টজ) ভিক্টরের গবেষণায় অর্থায়ন করেন। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে মৃতদেহ সংগ্রহ করে কৃত্রিম মানব তৈরি করতে চায় ভিক্টর, যা শেষ পর্যন্ত ভয়ঙ্কর কিন্তু হৃদয়বিদারক রূপে জীবন্ত হয়ে ওঠে—দানব (জ্যাকব এলর্ডি)।
নতুন দুনিয়া দেখে বিস্মিত হলেও শিগগিরই সমাজের নিষ্ঠুরতা বুঝতে শেখে সে। নিজের অস্তিত্বের বেদনাই তাকে পরিণত করে এক করুণ চরিত্রে।
অভিনয় ও নির্মাণশৈলী
দানবের চরিত্রে জ্যাকব এলর্ডির অভিনয় নিখুঁত—সংবেদনশীলতা, ভয়ের উপস্থিতি ও কোমলতার দারুণ মিশ্রণ। ইঁদুরকে আদর করার দৃশ্যটি তার অভিনয়ের গভীরতা স্পষ্ট করে।
উন্মাদ বিজ্ঞানী ভিক্টরের ভূমিকায় অস্কার আইজ্যাকও অসাধারণ। তার রাগ, হতাশা, উচ্চাকাঙ্ক্ষা—সবই বিশ্বাসযোগ্য। ক্রিস্টফ ওয়াল্টজ ও মিয়া গথও চরিত্রের সঙ্গে দুর্দান্তভাবে মানিয়ে গেছেন। দেল তোরো এলিজাবেথকে প্রচলিত রূপসীর চেয়ে আলাদা, ধূসর ভিক্টোরিয়ান সৌন্দর্যে হাজির করেছেন।

ভিজ্যুয়াল ও টেকনিক্যাল দিক
তামারা ডেভেরেলের সেট ডিজাইন, কেট হাওলির পোশাক এবং লাল–কালোর ব্যবহারে ভরপুর দেল তোরোর স্বাক্ষরী ভিজ্যুয়াল স্টাইল—সবই সিনেমাটিকে অনন্য করেছে। আলেকজান্ডার ডেসপ্লাটের সংগীত ও ড্যান লাউস্টসেনের ক্যামেরা পুরো সিনেমাকে গথিক আবহে মুড়ে দেয়।
তবে মাঝামাঝি অংশে কিছু দৃশ্য অতিরিক্ত বক্তব্যে ভারী মনে হয় এবং সিজিআইয়ের কয়েকটি শট—বিশেষ করে নেকড়ের দৃশ্য—পর্যাপ্ত বাস্তবসম্মত নয়।
সামগ্রিক মূল্যায়ন
গিয়ের্মো দেল তোরোর ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন’ শুধু ভয়ের গল্প নয়—এটি সৃষ্টি ও স্রষ্টার ট্র্যাজেডি, সমাজের নিষ্ঠুরতা এবং মানবিক বোধের গভীর অনুসন্ধান। দুই শতকের পুরোনো কাহিনি আজও যে প্রাসঙ্গিক, দেল তোরো তা আরেকবার প্রমাণ করলেন।
সিএ/জেএইচ


