তুর্কি নোবেলজয়ী লেখক ওরহান পামুক বলেছেন—পৃথিবীর সমস্ত ভালো উপন্যাসই কার্যক্ষেত্রে রাজনৈতিক উপন্যাস। কারণ, একটি ভালো উপন্যাস মানেই অন্য মানুষের মন, সমাজ, সময় ও ক্ষমতার কাঠামোকে পড়তে চাওয়া। তবে সাধারণ পাঠকের মনে ‘রাজনৈতিক উপন্যাস’ বলতে যে ধারণা তৈরি হয়—কেবল রাজনৈতিক চরিত্র, ঘটনা বা সময়কে কেন্দ্র করে বোনা গল্প—রায়হান রাইনের ‘নিখোঁজ মানুষেরা’ সেই প্রচলিত ধারণার বাইরে গিয়ে পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রের এক অন্ধকার অন্তরালের গল্প তুলে ধরে।
স্বল্পায়তনের হলেও উপন্যাসটি গত এক দশকের বাংলাদেশ রাষ্ট্রের রাজনৈতিক বাস্তবতার নানা গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত, দমন–পীড়ন, গুম-খুন, অন্যায় ও ক্ষমতার নির্মম ছায়াকে এক সূক্ষ্ম বয়ানে ছুঁয়ে যায়। পড়তে পড়তে পাঠক উপলব্ধি করে—এ শুধু একটি চরিত্রের গল্প নয়; বরং এক সময়ের ইতিহাস।
উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র ইউসুফ। মতিঝিলের দিলকুশার একটি গলিতে গুলিবিদ্ধ হয়ে চেতনা হারানোর পর সে পৌঁছে যায় আরেকটি ছায়াজগতে। সেখানে দেখা পায় ময়ূরজানকে—যে একসময় ইউসুফের প্রেমের মানুষ ছিল, আর এখন মৃত। সেই মৃত ময়ূরজানের কাছ থেকেই ছায়া-জগতের পথচলা শেখে ইউসুফ। ধীরে ধীরে তাদের সঙ্গে যোগ দেয় নিশাত, শকুন্তলা, রতন, কায়েসসহ আরও কয়েকজন কায়াহীন আত্মা।
এই আত্মাদের প্রত্যেকেই মৃত্যুর আগে কোনো না কোনো রাজনৈতিক অন্যায়ের শিকার—এ যেন ক্ষমতার ছায়ায় জন্ম নেওয়া এক মৃত্যুদলিলের জগত। পাঠক যখন ইউসুফের চোখ দিয়ে ছায়াজগতের পথ ধরে হাঁটে, তখন সামনে এসে দাঁড়ায় একেকটি শহর, মফস্বল, আর রাষ্ট্রের নির্মম রাজনৈতিক ইতিহাস।
ময়ূরজানের মেয়ে কাজলের বাবাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল কেবল নামের সাদৃশ্যের কারণে—সন্ত্রাসী ‘ছোট মনির’-এর সঙ্গে মিলে যাওয়ায়। নিশাতের লাশ উদ্ধার হয় ইটভাটার নিচ থেকে—যেখানে তাকে পুঁতে রেখেছিল গিয়াস কাউন্সিলরের লোকেরা। আর একদল নৃশংস মানুষের হাতে পড়ে হেলেনা ধীরে ধীরে বিকৃত হয়ে ওঠে ‘হেলেন’ হয়ে।
গল্প যত এগোয়, পাঠকের মনে তত বাড়ে হতাশা, ক্ষোভ এবং বেদনাবোধ। কারণ এখানে প্রতিটি মৃত্যু, প্রতিটি গুম, প্রতিটি নির্যাতন রাজনৈতিক ক্ষমতাবৃত্তের সরাসরি বা পরোক্ষ ফল। তাই ‘নিখোঁজ মানুষেরা’ নিছক একটি উপন্যাস নয়—এ বাংলাদেশের এক অব্যক্ত, অন্ধকার সময়ের দলিল।
রায়হান রাইনের ভাষা, বর্ণনাশৈলী, চরিত্র–অন্তর্দৃষ্টি—সবই মিলেমিশে এই উপন্যাসকে এক রাজনৈতিক সত্যের ছায়া-আয়না হিসেবে দাঁড় করিয়েছে। পাঠক শেষ পৃষ্ঠা পর্যন্ত টের পায়, ছায়াজগতের গল্প বলতে বলতে লেখক প্রকাশ করছেন বাস্তব জীবনের এক গভীর কিন্তু দহনকারী ইতিহাস—যেখানে নিখোঁজ মানুষগুলোই রাষ্ট্রের আরেক মুখ।
সিএ/এএ


