Home শিক্ষা আগুনে পুড়ে মৃত্যু: শাহাদাতের মর্যাদা

আগুনে পুড়ে মৃত্যু: শাহাদাতের মর্যাদা

0
ছবি : সংগৃহীত

বদরুল ইসলাম (বরগুনা)

আমরা প্রায়ই খবরের কাগজে, টেলিভিশনে কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ায় মর্মান্তিক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা দেখি। স্কুলে, বাড়িতে, কখনও কারখানায়, আবার কখনও সড়ক দুর্ঘটনায় আগুনে পুড়ে মানুষ মারা যায়। এ ধরনের মৃত্যুকে আমরা সাধারণত এক রকম করুণ ও দুঃখজনক পরিণতি হিসেবে দেখি। কিন্তু ইসলাম যে কী বিশাল দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে এই বিষয়গুলো মূল্যায়ন করে, তা অনেকেই জানি না।

রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন, কেবল রণাঙ্গনে নিহত হওয়াই শহীদ হওয়ার একমাত্র পথ নয়। ইসলামে শহীদের মর্যাদা লাভের আরও বহু মাধ্যম রয়েছে—এর মধ্যে একটি হলো আগুনে পুড়ে মৃত্যু।

নবীজির স্পষ্ট ঘোষণা: আগুনে পুড়ে মারা যাওয়াও শহীদের মৃত্যু

এক সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনে জাবের (রা.) তার পিতা জাবের (রা.)-এর সূত্রে বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) একবার জাবের (রা.)-কে অসুস্থ অবস্থায় দেখতে যান। তখন নারীরা জাবের (রা.)-কে ঘিরে বলছিলেন, “আমরা তো মনে করেছিলাম, তুমি শহীদ হয়ে মৃত্যুবরণ করবে।” তখন প্রিয় নবী (সা.) তাদেরকে থামিয়ে বললেন:

“আল্লাহর রাস্তায় নিহত ব্যক্তি শহীদ, পেটের পীড়ায় মৃত ব্যক্তি শহীদ, আগুনে পুড়ে মৃত ব্যক্তি শহীদ, পানিতে ডুবে মৃত ব্যক্তি শহীদ, চাপা পড়ে মৃত ব্যক্তি শহীদ, নিউমোনিয়াজাতীয় কঠিন পীড়ায় মৃত ব্যক্তি শহীদ এবং গর্ভাবস্থায় মৃত্যুবরণকারী নারীও শহীদ।”
(সুনানে আবু দাউদ, হাদিস: ৩১১১)

এই হাদিসটি একটি গভীর বার্তা বহন করে। আগুনে পুড়ে মৃত্যু হয়ত বাহ্যিকভাবে অত্যন্ত কষ্টকর, তবে অন্তর্নিহিতভাবে তা এক মহান মর্যাদার ঘোষণা বহন করে। যারা এইরূপ মৃত্যু বরণ করেন, তাদের জন্য রয়েছে শহীদদের মর্যাদা—যা আখিরাতে অপার পুরস্কার ও চিরস্থায়ী মর্যাদার নিশ্চয়তা দেয়।

শাহাদাত শুধু রণক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ নয়

ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী, শহীদের মর্যাদা শুধু সেইসব মুজাহিদদের জন্য নয় যারা তরবারি হাতে যুদ্ধের ময়দানে শহীদ হয়েছেন। বরং রাসুলুল্লাহ (সা.) এমন অনেক প্রকার মৃত্যুর কথা বলেছেন, যা কষ্টদায়ক, হঠাৎ আসা বা সঙ্কটপূর্ণ, কিন্তু যেগুলোর পেছনে রয়েছে ধৈর্য, ঈমান ও আল্লাহর প্রতি নির্ভরতা। আগুনে পুড়ে মৃত্যু সেসবের একটি।

ইমাম নববী (রহ.) বলেন, “এসব মৃত্যুর প্রকৃত কারণ হলো তীব্র কষ্ট, ধৈর্য ও ঈমানের পরীক্ষা। আর সে কারণেই এই কষ্টকর মৃত্যুগুলোকে আল্লাহ তাআলা শহীদের মর্যাদা দিয়েছেন।”

আমাদের সমাজে আগুনে পুড়ে মৃত্যু—নিয়তির অমোঘ পরিণতি নয়, হতে পারে সম্মানিত শাহাদাত

বর্তমান সময়ে বড় বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা আমাদের সামনে ঘটে যাচ্ছে। বাংলাদেশে বিভিন্ন সময় গার্মেন্টস কারখানা, কেমিক্যাল গোডাউন, বাস বা লঞ্চে ভয়াবহ আগুন লেগে অনেকেই প্রাণ হারিয়েছেন। পরিবার হারিয়েছে আপনজন, সমাজ হারিয়েছে কর্মক্ষম নাগরিক।

আমরা অনেক সময় নিহতদের জন্য কেবল দুঃখপ্রকাশ করি কিংবা শোক পালন করি। কিন্তু ইসলামের আলোকে এদের অনেকে হয়ত শহীদের মর্যাদা নিয়ে দুনিয়া ছেড়ে গেছেন। তাঁদের প্রতি সম্মান ও দোয়া থাকা আমাদের কর্তব্য। আমাদের উচিত এই হাদিসের আলোকে সমাজকে আশ্বস্ত করা—যে মৃত্যু যতই কঠিন হোক, ঈমান ও তাকওয়ার সঙ্গে হলে সেটি আল্লাহর কাছে এক সম্মানজনক অবস্থায় পরিণত হতে পারে।

শহীদের মর্যাদায় কী পাওয়া যায়?

কোরআন ও হাদিসে শহীদদের জন্য অনেক ফজিলত ও পুরস্কারের কথা বলা হয়েছে:

মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই জান্নাতের দরজা খুলে যায়।

কবরে জিজ্ঞাসাবাদ নেই।

কিয়ামতের দিন বিশেষ সম্মান ও সুপারিশের অধিকার লাভ।

শহীদদের রক্তের রং লাল হলেও তার ঘ্রাণ হবে মিশকের মতো সুগন্ধি।

একটি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন প্রয়োজন

আমরা যেন কষ্টদায়ক মৃত্যুকে শুধুই হতভাগ্য পরিণতি হিসেবে না দেখি। ইসলাম আমাদের শেখায়, যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে, ধৈর্যসহকারে, আল্লাহর প্রতি নির্ভরতা রেখে দুনিয়া ছাড়ে—সে ব্যক্তি নিঃসন্দেহে সৌভাগ্যবান। আগুনে পুড়ে যারা মারা যান, তাদের মৃত্যু তাই আমাদের চোখে করুণ হলেও, ইসলামের চোখে তা গৌরবময় হতে পারে।

ইসলামের সৌন্দর্য এখানেই—যেখানে মৃত্যু মানেই শেষ নয়, বরং এক অনন্ত জীবনের সূচনা। আগুনে পুড়ে মৃত্যু যারা বরণ করেন, আমরা যেন তাঁদের জন্য দোয়া করি, যেন তারা শহীদের মর্যাদায় আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ করেন। পাশাপাশি নিজেদের জীবনেও আমরা যেন ঈমান, তাকওয়া ও ধৈর্য ধরে রাখার চেষ্টা করি—কারণ, মৃত্যু যখনই হোক, যেন তা হয় সম্মানজনক একটি শাহাদাত।

“হে আল্লাহ! আমাদের সকল প্রকার মৃত্যু শাহাদাতের মর্যাদায় কবুল করে নাও। আমিন!”

NO COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Exit mobile version