সাম্প্রতিক সময়ে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত ডিমের বাজারদর উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। গত কয়েক বছর ধরে ডিমের দাম বেশি থাকায় খামারিরা উৎপাদন বাড়িয়েছিলেন। তবে চাহিদার তুলনায় উৎপাদন বেড়ে যাওয়ায় এখন বাজারে তার নেতিবাচক প্রভাব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ফলে বড় ধরনের দরপতনে ক্ষতির মুখে পড়েছেন দেশের খামারিরা।
গত বুধবার (৪ ডিসেম্বর) রাজশাহীতে খামার গেটে সাদা রঙের ডিম প্রতি পিস ৭ দশমিক ১০ টাকা এবং বাদামি রঙের ডিম ৮ দশমিক ১০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। বর্তমান হিসাব অনুযায়ী, খামারিরা গড়ে প্রতি ডিমে কমপক্ষে ১ টাকা করে লোকসান গুনছেন।
রাজশাহীর গোদাগাড়ীর কলিপুর গ্রামের খামারি জেয়ারুল ইসলাম (৩২) বলেন, শীতকালে সাধারণত ডিমের দাম কিছুটা কমে। কিন্তু এবার দাম এতটাই কম যে খামার টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। তার মতে, বাজারের চাহিদার তুলনায় ডিমের উৎপাদন এখন অনেক বেশি।
জেয়ারুল ইসলামের খামারে ৬ হাজার ৫০০টি মুরগি রয়েছে। সেখান থেকে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৫ হাজার ৩০০টি ডিম পাওয়া যায়। তিনি জানান, অক্টোবরে যেখানে সাদা ডিমের দাম ছিল ৮ দশমিক ১০ টাকা এবং বাদামি ডিমের দাম ছিল ৯ দশমিক ১০ টাকা, সেখানে এখন প্রতি ডিমে প্রায় ১ টাকা করে দাম কমেছে। শুধু নভেম্বর মাসেই তার প্রায় ৫০ হাজার টাকা লোকসান হয়েছে।
ডিমের দরপতনের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে জেয়ারুল ইসলাম বলেন, খামারের সংখ্যা ও উৎপাদন দুটোই বেড়েছে। পাশাপাশি শীতকালীন শাকসবজি ও স্থানীয় জাতের মাছ বাজারে প্রচুর থাকায় অনেক ভোক্তা ডিমের ব্যবহার কমাচ্ছেন।
গোদাগাড়ীর দোগাছী এলাকার ২ হাজার ২০০টি লেয়ার (সাদা) মুরগির খামারি সুজন আলী (২৬) বলেন, তার খামারে ডিম উৎপাদন ৯০ শতাংশের বেশি। কিন্তু প্রতিটি ডিম উৎপাদনে প্রায় ৮ টাকা খরচ হলেও বিক্রি করতে হচ্ছে ৭ টাকারও কম দামে। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, এই অবস্থা চলতে থাকলে খামার চালাতে অন্য উৎস থেকে অর্থ জোগান দিতে হবে।
পবা উপজেলার আফি নেপালপাড়ার স্নাতক শিক্ষিত নতুন খামারি মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান (২৭) জানান, তার ১ হাজার ৩০০টি মুরগির খামার থেকে প্রতিদিন প্রায় ১ হাজার ২৫০টি ডিম পাওয়া যাচ্ছে। উৎপাদন ভালো হলেও বাজারদরের কারণে ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভুগছেন তিনি।
জেলায় ডিমের বড় আড়তদারি মোকাম পবার মোসলেমের মোড়ে রকি ট্রেডার্সের ব্যবস্থাপক মিজানুর রহমান (৩২) বলেন, প্রতিদিন তারা প্রায় ৫৫ হাজার ডিম ক্রয়-বিক্রয় করেন। সম্প্রতি পাইকারদের চাহিদা কমে যাওয়ায় অপ্রত্যাশিতভাবে দাম পড়ে গেছে। এতে খামারিরা উৎপাদন খরচ তুলতেও পারছেন না।
একই এলাকার বড় খামারি ও ব্যবসায়ী জয়নাল আবেদীন জানান, অতিরিক্ত লোকসানের আশঙ্কায় তিনি নিজের ৩০ হাজার মুরগির খামার অর্ধেকে নামিয়ে এনেছেন। তিনি বলেন, ডিম উৎপাদন ঠিক থাকলেও চাহিদা না থাকায় বিক্রি করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে অনেক প্রান্তিক খামারি বাজার থেকে ছিটকে পড়বেন।
ডিমের বাজার পরিস্থিতি সম্পর্কে কাজী ফার্মসের পরিচালক কাজী জাহিন হাসান বলেন, ডিমের দাম পুরোপুরি চাহিদা ও সরবরাহের ওপর নির্ভরশীল। গত কয়েক বছর দাম বেশি থাকায় উৎপাদন বেড়েছে। তার ভাষ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে বাণিজ্যিক খামারগুলো থেকে প্রতিদিন ৫ দশমিক ২ কোটিরও বেশি ডিম উৎপাদিত হচ্ছে, যেখানে গত বছর এই সময়ে উৎপাদন ছিল প্রায় ৩ দশমিক ৫ কোটি ডিম। বর্তমান দরপতনই প্রমাণ করে যে সরবরাহ চাহিদাকে ছাড়িয়ে গেছে।
কার্টেল প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যদি সত্যিই কোনো কার্টেল থাকত, তাহলে দাম এভাবে কমত না। বাস্তবতা হলো—হাজার হাজার খামারি ও বিক্রেতার কারণে এই বাজার স্বভাবতই প্রতিযোগিতামূলক।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আসরার চৌধুরী বলেন, ডিম একটি পচনশীল পণ্য হওয়ায় দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা যায় না। ফলে খামারিরা দ্রুত বিক্রি করতে বাধ্য হন, যা দামের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। তিনি আরও বলেন, শীতকালে শাকসবজি ও বিকল্প খাদ্যের প্রাপ্যতা বাড়ে। এসব পণ্যের দাম সহনীয় হলে মানুষের খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আসে এবং ডিমের চাহিদা কমে যায়। চাহিদা-সরবরাহের ভারসাম্যহীনতা, বিকল্প খাদ্যের প্রাচুর্য ও পচনশীলতা—এই তিনটি বিষয়ই ডিমের দরপতনের মূল কারণ।
সিএ/এএ


