জুলাইযোদ্ধা শরিফ ওসমান হাদির ওপর প্রাণঘাতী হামলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে পারস্পরিক দোষারোপে উদ্বিগ্ন অন্তর্বর্তী সরকার। নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র প্রতিরোধে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস নির্বাচনমুখী দলগুলোকে পারস্পরিক বিরোধ ভুলে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। শনিবার (৬ ডিসেম্বর) রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টার আহ্বানে সাড়া দেওয়ার কথা জানিয়েছে তিন দলই।
বৈঠকে অংশ নেওয়া দলগুলোর নেতারা ওসমান হাদির পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ঐক্যবদ্ধ থাকার প্রতিশ্রুতি দেন। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, পরস্পরকে দোষারোপ থেকে বিরত থাকতে হবে। জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, দলীয় স্বার্থে একে অন্যকে প্রতিপক্ষ বানিয়ে ফেলার প্রবণতা তৈরি হয়েছে। এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, দলগুলোর টানাপোড়েনে জুলাই অভ্যুত্থানের চেতনা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং জানায়, বৈঠকে দলগুলো ঐক্যবদ্ধ থাকার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছে। তবে বৈঠকের পরও পারস্পরিক কাদা ছোড়াছুড়ি পুরোপুরি থামেনি। সামাজিক মাধ্যমে ছড়ানো ভুয়া ফটোকার্ড ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় তৈরি ছবির বরাতে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী দাবি করেন, হাদির ওপর গুলিবর্ষণে জামায়াত-শিবির দায়ী বলে পুলিশ জানিয়েছে। পরে ফ্যাক্টচেকে বক্তব্য মিথ্যা প্রমাণিত হলে তিনি দুঃখ প্রকাশ করেন।
এর আগেই জামায়াত রিজভীর বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়ে ক্ষমা চাইতে বলে। সামাজিক মাধ্যমে দুই দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে বিষোদ্গার অব্যাহত থাকে। হাদির ওপর হামলার প্রতিবাদে আয়োজিত বিভিন্ন সমাবেশ থেকেও দলগুলো একে অপরকে আক্রমণ করে বক্তব্য দেয়।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে দলগুলো এককাতারে থাকলেও নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, ততই পারস্পরিক দোষারোপ বাড়ছে। বিভিন্ন এলাকায় হামলা-মারামারির ঘটনাও ঘটছে। শুক্রবার (৫ ডিসেম্বর) দুপুরে নির্বাচনী জনসংযোগের সময় ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ও সম্ভাব্য প্রার্থী শরিফ ওসমান হাদিকে গুলি করার পর প্রার্থীদের নিরাপত্তা নিয়ে নতুন করে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।
হাদির ওপর সন্দেহভাজন গুলিবর্ষণকারী ফয়সাল করিম মাসুদ ওরফে দাউদ খানের ছাত্রলীগ সংশ্লিষ্টতার তথ্য সামনে আসার পর ধারণা করা হচ্ছে, নির্বাচন বানচালে আওয়ামী লীগ জড়িত থাকতে পারে। এই প্রেক্ষাপটে শনিবার যমুনায় বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন প্রধান উপদেষ্টা।
বৈঠকে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ক্ষমতাচ্যুত শক্তি নির্বাচন বানচাল করতে চাইছে এবং এর জন্য প্রশিক্ষিত শুটার মাঠে নামানো হয়েছে। তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যাচ্ছে, ষড়যন্ত্রকারীরা তাদের নেটওয়ার্ক বিস্তৃত করেছে। হাদির ওপর হামলাকে তিনি একটি ‘সিম্বলিক’ সতর্কবার্তা হিসেবে উল্লেখ করেন।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ষড়যন্ত্রকারীদের উদ্দেশ্য হচ্ছে নির্বাচন হতে না দেওয়া। তারা তাদের শক্তি প্রদর্শন করতে চায় এবং নির্বাচনের সব আয়োজন ভেস্তে দিতে চায়। এসব মোকাবিলায় সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। তিনি দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানান, রাজনৈতিক বক্তব্য থাকবে, কিন্তু কাউকে শত্রু ভাবা বা আক্রমণের সংস্কৃতি থেকে সরে আসতে হবে। নির্বাচনী উত্তেজনাও যেন নিয়ন্ত্রিত থাকে, সেদিকে নজর রাখতে হবে।
আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে হানাহানি শুরু হওয়ার পর থেকেই আওয়ামী লীগ শক্তিশালী হয়েছে। তিনি দলগুলোর প্রতি জাতীয় স্বার্থকে দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে রাখার আহ্বান জানান।
বৈঠকে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, যে কোনো পরিস্থিতিতে পরস্পরের দোষারোপ বন্ধ রাখতে হবে এবং অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার ও ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান জোরদারের পরামর্শ দেন। গোলাম পরওয়ার বলেন, একে অন্যকে দোষারোপের কারণে বিরোধীরা সুযোগ পাচ্ছে। নাহিদ ইসলাম বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানবিরোধী বয়ান তৈরি করে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টিকে ‘নরমালাইজড’ করার চেষ্টা চলছে।
বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমেদ বীরবিক্রম, জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এহসানুল মাহবুব জুবায়ের এবং এনসিপির মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ। বৈঠকের বাইরে নাহিদ ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, হাদিকে হত্যাচেষ্টার পেছনে আওয়ামী লীগ ও ভারতের সম্পৃক্ততা থাকতে পারে।
এদিকে শনিবার ওসমান হাদির পরিবারের সদস্যরা যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। হাদির সর্বোত্তম চিকিৎসা ও অপরাধীদের বিচারের আশ্বাস দেন তিনি। সাক্ষাতে উপস্থিত ছিলেন হাদির ভাই আবু বকর সিদ্দীক, বোন মাসুমা এবং ইনকিলাব মঞ্চের নেতারা।
হাদির ওপর হামলার প্রতিবাদে শনিবার ও রোববার (৭ ডিসেম্বর) দেশের বিভিন্ন জেলায় বিএনপি, জামায়াত, এনসিপি ও অন্যান্য সংগঠনের উদ্যোগে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। কয়েকটি স্থানে মশাল মিছিল, সড়ক অবরোধ ও প্রতিবাদ কর্মসূচিও পালন করা হয়। ঝালকাঠিতে এক বিক্ষোভ মিছিলে দুই পক্ষের হাতাহাতিতে আহতের ঘটনাও ঘটে।
সিএ/এএ


