বিব্রত কিংবা না জানা অস্বস্তি
আদিত্য আবরার
‘দু’চার লাখ টাকা দিয়ে মজিবর কাজীগিরির কাজটা নিলেও নিলুফার কোনো ভাবান্তর ছিল না, বলা যায় একটু বেশি সুখেই আছে। সপ্তাহে তিন চারদিন বাইরের খাবার দিয়েই ওদের সংসার চলে যাচ্ছে, এটা একটা ভালো দিক’।
ঠাণ্ডাতে জমে যাওয়া কিংবা আড়ষ্ট হওয়ার আগে অনেকেই অনেক কিছু করেন, গরম কাপড়ের ভীড়ে হারান একটু ধনী পর্যায়ের কেউ। আবার গ্রামের মধ্যমা ও গরিবের ছা’গুলো আনন্দেই আগুন জ্বালায় বাড়ীর উঠোনে। মাঝ দিয়ে ছিড়ে ফেলা লুঙ্গিটা বাচ্চাছেলের মাথায় টুপলি মতো পরিয়ে “স্বাজাল তাপানো’র” জন্য পাঠিয়ে দেয় ব্যাস্ত মা। গোয়ালের গরু কিংবা ছাগল খুব হাঁকডাক পাড়ছে। ক্ষুধার্ত কিংবা অপরিচ্ছন্নতার ভেতর থাকতে না পারার কারণে। আবর্জনাতে ক্লান্তি, ব্যাপারটা কি জানোয়ারগুলোও বুঝে!
যেন কোনো অবোধ বাচ্চার অস্পষ্ট কান্নার শব্দহীন ক্লেশ। এতে মানুষ অনেক কিছু বুঝে, অনুধাবন করে। কোনো সময় খিদে মেটানো, কোনো সময় প্রসাব পাল্টানো আবার কখনো অসুস্থতাজনিত অবস্থার অস্বস্তিকর অবস্থা বোঝানো! আচ্ছা, একটা বাচ্চা- সেতো মানুষ! তাহলে তার এক কান্নায় এত্তকিছু মানুষ বুঝে নিচ্ছে কেন? বা কিভাবে?
খুব উচ্ছল আর উদ্দীপনা নিলুফার ভেতর কাজ করছে। যেন কোনো নিরানন্দ কিংবা অযাচিত কিছু ঘটে যাওয়ার পর সব কিছু আনমনেই ফিরে আসছে। সকাল সকাল কাজের বুয়ার মত বাসার সব কাজ গুছিয়ে স্বামীকে বিদায় করা আর তারপরেই সবকিছু টালমাটাল! একটু ভিন্নতর! এইযে আলিয়ায় পড়া অর্ধহুযুর কি সব বুঝে না! কিংবা জানলেও মানে না। ভরা পেটে সঙ্গমে আসা কিংবা একইজনকে বারবার বীর্য রাখার পাত্র বানানোর জন্য স্থির করা, এটা অনধিকার চার্চার দাবি রাখে না? শর্ট পাঞ্জাবি আর প্যান্টের তলায় মুচড়ানো শিশ্নটা যখন নিলুফার শরীর স্পর্শ করে, নিরবধি কেঁপে ওঠাটা তার জন্য তখন যেন পানি সদৃশ!
এগুলো স্বামি-স্ত্রীর চাহিদা কিংবা আকর্ষণের শেষ স্তর বলা যেতে পারে। আনন্দঘামে একে অপরের সাথে লেপ্টে থাকা আর সকাল হলে মাথায় কাঁথা বালিশ দিয়ে রাতকে ডেকে আনা, এটা তাদের জীবনসমাচার। নিলুফা সহসা আবার কেঁপে ওঠে। কোনো পুরুষ্টু শক্ত মাংশপিন্ড রাতের মতো এই দিনেও শুষে নিতে চাচ্ছে। কিন্তু এগুলো তার মনে আসছে কিভাবে? কর্পূরের মতো অদেখাতেই ভাবনাগুলো উড়ে যায়।
থালাবাসন পড়ার ঝন-ঝন আওয়াজ শুনে রান্নাঘরের দিকে ছুটতে চায় নিলুফা। জানে, এটা মজিবরের পোষা বিড়ালের লোভের ফল। নিজে নিজেই ভয় পাওয়া সাথে সাথে নাড়িয়ে দেয়া অন্যকে। নিলুফা থেমে যায়। নামে না খাট থেকে। যেন কোনো দমকা অস্থির বাতাস ওড়িয়ে নিতে চাচ্ছিল কিন্তু মানুষগুলো অতিরিক্ত ভালো হওয়াই ফিরিশতারা তাদের না উড়িয়েই ছেড়ে দিল! নিলুফা চুপচাপ ওপারের কারো কথা শুনছে। অপরিচিত, অজানা কারো সাথে কথা বলাতে এত্ত আনন্দ লাগছে কেন? প্রকৃতির কিছু অদ্ভুত নিয়মের মতো এটাও একটা উদ্ভট চিন্তা। কোনোকিছুই ভালো লাগছে না তার। কাজী স্বামী বাসায় পৌছবে আর কিছুক্ষণ পর, আবার শুরু হবে কতকিছু। এটাতে ঝগড়া কিংবা রাগ না করে কিছুক্ষণ চুপ থাকারও অপশন রেখেছে তার কাজী স্বামী। “আমি রান্নায় যাব, এখন রাখো”। ফোন রাখতে গিয়ে বুকে হাত দেয় নিলুফা, হার্টবিট এমন হচ্ছে কেন? যেন প্রেশার কিংবা টেনশনে মাথা ঘুরছে বনবন করে, শরীরের ইমেজও চলে গেছে খুব ভালোভাবে! এমন তো হওয়ার কথা ছিল না, আবার বিরক্ত হয় নিলুফা। অস্থিরতাকে প্রশ্রয় না দেয়ার জন্য আবার ফোনে কথা বলা শুরু হয়। একাকী কিংবা ভাসমান অবস্থান এদু’টোই ডিপ্রেশন বাড়ায়। ফোন দিয়ে কানে ওঠাতে মন চায় না নিলুফার! ঘুম। অরাজকতা থেকে নির্বাক মুক্তি।
ক্লিক ক্লিক ক্লিক! তিন টোনে বোঝাতে চায় ফোনের চার্জ এখন পাঁচ পার্সেন্ট।
.
সরকারি টাকায় লাগানো সাদাকালো সাইনবোর্ডের ঘরটা মোটামুটি মনোরম। মনোহরি বলা চলে না, ঘরের একপাশে ময়লা ভর্তি ঝুড়ি, দুইহাত লম্বা ফুলের ঝাড়ুটারও কস্টেপ-বাধন দুটোই খুলে পেটে ছুরি মেরে নাড়িভুঁড়ি বের করে দেয়ার মত অবস্থা। সাথে কাঠের জানালার উপরে ময়লার পুরু। আর কাঠের উপর থেকে ময়লা ওঠাতে হলে ভেজা ন্যাকড়া বা অন্য কোনো মাধ্যমে সেটাকে পরিষ্কার করা যাবে, মজিবরের ওগুলো নিয়ে তেমন ভাবনা নেই। কারণ জবাবদিহিতা করতে হবে যে এমন ভীতিকর অবস্থাতে পড়ার আশংকাও কম। এইযে এখন বেলা এগারোটা, মজিবরের ঘুম কিংবা ঝিমোনোর স্টাইল দেখে সেটা বেলা দুইটা সদৃশ মনে হবে! একটু পরে আভিজাত্যদের সম্মানের জন্য রাখা ময়লা সোফাতে শুয়ে পূর্ণ ঘুমটা সেরেই উঠবে।
সহকারীকে না ডাকার জন্য আগেই শাসানো আছে, আলাভোলা দেখে রেখেছিল কিন্তু অতি চালাকের সঙ্গে থেকে একটু হলেও বাড়তি টাকা কামানোর চোখ ফুটে গেছে! সময় সবকিছু যেমন পাল্টে দেয়, পাল্টিয়েছে তার ভৃত্যকেও!
মজিবর বেঘোরে ঘুমুচ্ছে, যেন রাজ্যের ক্লান্তি তার উপরই ভর করেছে। স্বপ্নরা তাদের কীর্তন দেখানোর মোক্ষম সুযোগ খুঁজতে থাকে, এবং তাদের প্রচেষ্টা সফলতার মুখ দেখে।
আতিকুর গ্রামের একমাত্র ছেলে যে কোনো কামকাজের ধারের কাছেও যায় না, এমনকি দিনের পর দিন অভুক্তও কাটিয়ে দেয়। কিন্তু এই অভুক্ত ব্যাপারটা আতিকুরের বাবা মা তেমন গায়ে মাখে না, নিজেদের পেটেই আগুন আর ছেলে তো বুঝের। এখন ওর সবকিছু ও করে নিক। মজিবরের সেদিন প্রথম আতিকুরকে দেখেছিল, পায়ের বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে মাটি খোঁচাতে, গভীর মনোযোগে, একমনে।
তিনবেলা খাবার আর রাতে অফিসেই থাকার জাইগা করে দিয়েছে মজিবর। এখন আতিকুরের দিনকাল বেশ ভালোই।
“সাক্ষীর জন্য কাউকে এনেছেন”? ছোটো ছোটো দু’জন ছেলেমেয়ে এসেছে অফিসে, বিয়ে করবে। কিন্তু সাথে কেউ নেই। মেয়েটা শরম আর বিহ্বলতায় একরকম কাঁপছে। হালকা। হেমন্তের মন ভালো করা বাতাস যখন একটু অতিরিক্ত ঠাণ্ডা বহায়, একটু কেঁপে কেঁপে ওঠে তনুমন। ঠিক তেমনই হচ্ছে মেয়েটির। এদিক থেকে ছেলেটা বেশ স্মার্ট। সবকাজ একটু দ্রুত করতে বেশি বেশিই তাগিদ দিচ্ছে। আতিকুরকে বাইরের কাউকে ডেকে আনতে বলে সাক্ষী দেয়ার জন্য, কিন্তু ছাবেদ চাচা ছাড়া আর কাউকে চোখে পড়ে না মজিবরের সহকারীর। তখনই ঝোপ বুঝে কোপ মারে কাজী। এক্সট্রা টাকার কথা বলে সাক্ষীর জন্য। শেষমেশ বিয়েটা তাদের হয়।
বিয়ে দিয়ে দেয়া ঐ যুগল এখন মজিবরের সামনে। ওদের সাথে ফুটফুটে একটা বাচ্চা। কথা বলছে। আম্মু আম্মু বলে ডাকও দিচ্ছে। কিন্তু ওদের বাবা মায়েরা নির্বাক। মেয়েদের কাজলপরা চোখও যে কখনো আগুনশিখা হয়ে উত্তাপ ছড়ায়, মজিবর সেটা একটু একটু অনুভব করছে। ছেলেটা চুপচাপ। তবে একটু পরেই ঘটল আসল ঘটনা। আমাদের বিয়ে দিয়েছিলেন না আপনি? এখন ডিভোর্সও করাবেন আপনি! উঠুন, সুন্দরীদের মতো ড্যাবড্যাব করে কাউকে আকৃষ্ট করার দরকার নেই। ঘৃণা আর সংশয় মিশ্রিত এই কথাগুলো আজ যে মেয়েটা মজিবরকে বলছে সেই কিন্তু বিয়ের দিন সম্পূর্ণ স্তব্ধ ছিল।
ডিভোর্স লেটার সাইন করে “যে বাড়তি টাকা বিয়ের সময় নিয়েছিলেন সেটা দিয়েই মনে হয় এর বিল মিটে যাবে” বলে আবার হাঁটা দেয়। মজিবর স্থুল কোনো অতিকায় মানুষের মতো দীর্ঘশ্বাস ফেলে। গরম বাতাস হাতের ত্বকে পড়ায় ঝলসে যাবে মনে হলো।
আস্তে করে উঠে আতিকুরকে ডাকে মজিবর। বাসায় যাবে বলে হাতে কিছু টাকা ধরিয়ে দেয়। দুপুরের খবারের জন্য। পুরো শরীর ঘামে জ্যাবজ্যাবে। জামার কলার থেকে পাজামার রাবার পর্যন্ত স্পষ্ট ভেজার আভাস। জামার হাতায় বারবার মুখের ঝিকমিক করা লোনাপানি মুছতে চায়। স্বপ্ন দেখছিল এতক্ষণ। রাস্তার পাশে চায়ের দোকানি ছাবেদ চাচার প্রতিদিন কারো না কারো সাথে ঝগড়া বাধবেই, আজও বেঁধেছিল। আর সেই চিল্লাচিল্লিতেই ঘুম স্বপ্ন সব উধাও। তারপরেও খানিকটা সময় চোখবুজে শুয়ে ছিল মজিবর। এখন হাঁটছে। বাসায় যাবে। সন্ধ্যায় চিতই পিঠা বানাতে চল্লিশোর্ধ স্বামীস্ত্রীরা রাস্তার পাসে বসে। আজও ব্যাতিক্রম হয়নি। মজিবর একটু দূরত্ব বজায় রেখে ওদের দিকে তাকিয়ে থাকে। পুরুষ লোকটি বারবার তার পান খেয়ে লাল করে থাকা স্ত্রীর দিকে তাকাচ্ছে। মহিলা বেশ বিব্রত হচ্ছে এতে। পুরুষ লোকটি ব্যাপারটা বুঝেও বারবার খেয়াল করছে।
মজিবর আবার বাসায় ফেরার জন্য উদ্দ্যত হয়। নিলুফার সাদামাটা মুখটা ভাসছে মজিবরের চোখে। একদম পাখি ডানা ঝাপটিয়ে উড়ে বেড়ানোর মতো সামনে দিয়ে বারবার চলে যেতেও দেখছে। সেই কবে তারা মিলিত হয়েছিল, মনে করতে পারে না মজিবর। আজকের স্বপ্ন, রাস্তার পিঠা বানানো মহিলাকে বিব্রতকরণ এদের অবস্থা আনমনেই ভাসে মজিবরের চোখের পর্দায়। যে সাদা কাপড়টা খুব পিচ্ছিল, প্রজেক্টের আলোকছটা যাকে আরো রাঙিয়ে দিতে পারে। ওদের মিলন, আলোয় আর দ্বিপদীর রতিক্রিয়ার ব্যাপারটা মাথায় আসতেই থেমে পড়ে। নিলুফা রাগে একদিন বলেছিল “দেখো যা আমার বংশে কেউ কোনোদিন করেনি, আমি কিন্তু সেটা করব”। কথাটা বারবার কানে কুচকাওয়াজের ঝংকারের মত বাজে। কেন বলেছিল কথাটা? ভেবে কুলিয়ে উঠতে পারে না মজিবর।
আচ্ছা, আপনজনকে সময় না দেয়াতে কারো কোনো ক্ষতিসাধন করতে হয়?
লেখক পরিচিতি :
স্টুডেন্ট, ফরিদাবাদ আরবি বিশ্ববিদ্যালয়, গেণ্ডারিয়া, ঢাকা।