দুই বছরের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ও ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের পর অবশেষে গাজায় যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়েছে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনি গোষ্ঠী হামাস। তবে এই যুদ্ধবিরতি ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর জন্য স্বস্তির বদলে নতুন রাজনৈতিক বিপদের দ্বার খুলে দিয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, গাজা যুদ্ধকে নেতানিয়াহু নিজের রাজনৈতিক অবস্থান শক্ত করা এবং চলমান দুর্নীতি মামলার চাপ থেকে মনোযোগ সরানোর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। কিন্তু যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর তার সেই সুরক্ষা বলয় ভেঙে পড়তে পারে।
আন্তর্জাতিকভাবে আরও একা হচ্ছেন নেতানিয়াহু
বিশ্ব রাজনীতিতে ইসরায়েলের বর্তমান নিঃসঙ্গতা নজিরবিহীন। গত দুই বছরে গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত হয়েছেন অন্তত ৬৭ হাজার ফিলিস্তিনি। খাদ্য অবরোধে সৃষ্ট দুর্ভিক্ষ, ধ্বংসস্তূপে পরিণত শহর এবং শিশুদের মৃত্যু—এসব চিত্র বিশ্বজুড়ে তীব্র ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। এখন যদি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোকে গাজায় প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়, তবে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আরও স্পষ্টভাবে সামনে আসবে, যা নেতানিয়াহুর কূটনৈতিক অবস্থানকে দুর্বল করবে।
জোটে ভাঙন ধরার আশঙ্কা
নেতানিয়াহুর ডানপন্থি জোট সরকারও এখন ভাঙনের মুখে। যুদ্ধবিরতির বিরোধিতা করলেও অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোট্রিচ ও জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন গভির এখনো তার মন্ত্রিসভায় আছেন। তবে তাদের সমর্থন অনিশ্চিত। যদি আন্তর্জাতিক আদালত ইসরায়েলকে দোষী সাব্যস্ত করে, তবে চরমপন্থিরা নেতানিয়াহুর ওপর চাপ বাড়াবে এবং জোট সরকার টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে।
আইসিসি ও আইসিজের রায় হতে পারে মারাত্মক ধাক্কা
২০২৪ সালের নভেম্বরে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) গাজায় যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে নেতানিয়াহুসহ তিনজনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। পাশাপাশি, আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে) ইসরায়েলের বিরুদ্ধে জাতি হত্যার মামলার শুনানি করছে। যদি রায় নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে যায়, তাহলে তার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
ওয়াশিংটনের সম্পর্ক নিয়ে অনিশ্চয়তা
যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় মিত্র, কিন্তু সেই সম্পর্কেও ফাটল ধরেছে। সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০২১ সালে নেতানিয়াহুর ওপর ক্ষুব্ধ হন এবং পরবর্তীতে তার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন বলে জানা যায়। বিশ্লেষকরা বলছেন, ট্রাম্প আবার ক্ষমতায় ফিরলে নেতানিয়াহুর ওপর নির্ভরতা আরও বাড়বে, তবে ট্রাম্পের সমর্থনের সীমা আছে। তিনি যদি মুখ ফিরিয়ে নেন, নেতানিয়াহু এক গভীর কূটনৈতিক সঙ্কটে পড়বেন।
নিরাপত্তা ব্যর্থতার তদন্ত অনিবার্য
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের আকস্মিক হামলায় ১,১৩৯ জন ইসরায়েলি নিহত হন এবং প্রায় ২৫০ জনকে জিম্মি করা হয়। এই ঘটনায় গোয়েন্দা ও সেনা ব্যবস্থার মারাত্মক ব্যর্থতা ধরা পড়ে। পৃথক তদন্তে সেনা ও গোয়েন্দা প্রধানরা পদত্যাগ করলেও নেতানিয়াহু নিজের সরকারের ভূমিকা নিয়ে তদন্তে বাধা দেন। কিন্তু যুদ্ধবিরতির পর ইসরায়েলের সর্বোচ্চ আদালত রায় দিয়েছে, এই তদন্ত আর বিলম্বিত করা যাবে না।
দুর্নীতি মামলায় কারাদণ্ডের আশঙ্কা
নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে তিনটি দুর্নীতি মামলা চলছে—যার মধ্যে রয়েছে ঘুষ, জালিয়াতি ও আস্থাভঙ্গের অভিযোগ। এসব মামলায় দোষী সাব্যস্ত হলে তার ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে। যুদ্ধের সময় মামলার কার্যক্রম ধীরগতি পেলেও থেমে যায়নি। এখন যুদ্ধবিরতির পর বিচার প্রক্রিয়া আরও দ্রুত এগিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
ফলে যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পরও নেতানিয়াহুর সামনে একাধিক রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও আইনি ঝুঁকি অপেক্ষা করছে। অনেকেই বলছেন, এই যুদ্ধবিরতি হয়তো গাজার শান্তির সূচনা, কিন্তু নেতানিয়াহুর জন্য এটি হতে পারে এক নতুন সংকটের শুরু।
সিএ/এমআর