রাজধানীর মিরপুরের রূপনগর শিয়ালবাড়ি এলাকায় একটি পোশাক কারখানা ও রাসায়নিকের গুদামে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে অন্তত ১৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। দগ্ধ ও আহত হয়েছেন আরও অনেকে। মঙ্গলবার (১৪ অক্টোবর) বেলা সাড়ে ১১টার দিকে আনোয়ার ফ্যাশন নামে ওই পোশাক কারখানায় আগুন লাগে। পরে পাশের রাসায়নিকের গুদামে বিস্ফোরণ ঘটলে আগুনের ভয়াবহতা বেড়ে যায়।
ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, আগুনের সূত্রপাত ও বিস্ফোরণের কারণ এখনো জানা যায়নি। তবে ভবনে কোনো অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা ছিল না এবং ছাদে যাওয়ার দরজায় তালা ঝুলছিল। ফলে অনেকে বের হতে পারেননি। উদ্ধার হওয়া মরদেহগুলোর বেশিরভাগই চেনার অযোগ্য। পরিচয় নিশ্চিত করতে ডিএনএ পরীক্ষার প্রয়োজন হবে।
ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন) লেফটেন্যান্ট কর্নেল তাজুল ইসলাম জানান, দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলার মাঝামাঝি স্থানে আটকা পড়ে অনেকেই মারা গেছেন। রাসায়নিক বিস্ফোরণ থেকে নির্গত বিষাক্ত গ্যাসে অচেতন হয়ে তারা প্রাণ হারিয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। তিনি জানান, গুদামে ব্লিচিং পাউডার, পটাশ, এনজাইম, লবণ, হাইড্রোজেন পারঅক্সাইডসহ অন্তত ছয়-সাত ধরনের রাসায়নিক মজুত ছিল।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, পোশাক কারখানার নিচতলায় ওয়াশিং ইউনিটে প্রথম আগুন লাগে। এরপর পাশের রাসায়নিকের গুদামে বিস্ফোরণ হয়। মুহূর্তেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে পুরো ভবনে। আগুনে ভবনের সামনের তিনটি মোটরসাইকেল ও একটি কাভার্ড ভ্যানও পুড়ে যায়।
বিকেল ৫টার দিকে ঘটনাস্থলে অ্যাম্বুলেন্সে করে একে একে মরদেহগুলো উদ্ধার করা হয়। রাতে সেগুলো ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়। স্বজনদের আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে রূপনগর এলাকা। অনেকে প্রিয়জনের ছবি হাতে মরদেহ শনাক্তের চেষ্টা করেন।
ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জাহেদ কামাল রাতে ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে বলেন, “বারবার সতর্ক করার পরও আবাসিক এলাকায় রাসায়নিক গুদাম স্থাপন করা হচ্ছে। এটি মারাত্মক অবহেলা। ভবনটির কাঠামো দেখে মনে হচ্ছে নির্মাণে কোনো বিল্ডিং কোড মানা হয়নি।” তিনি জানান, আজ বুধবার বুয়েটের একটি বিশেষজ্ঞ দল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করবে।
ফায়ার সার্ভিসের ১২টি ইউনিট রাত পর্যন্ত আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করলেও রাসায়নিক গুদামে আগুন দীর্ঘ সময় ধরে জ্বলতে থাকে। উদ্ধার অভিযান পরিচালনায় ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা অংশ নেন।
দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী জানান, নিহতদের পরিবারকে বিএনপির পক্ষ থেকে এক লাখ টাকা করে সহায়তা দেওয়া হবে। তিনি বলেন, “সরকার পরিবর্তন হলে আবাসিক এলাকায় শিল্পায়নের মতো ঝুঁকিপূর্ণ অব্যবস্থাপনা দূর করতে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নিহতদের পরিবারের প্রতি গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। তারা দ্রুত তদন্ত ও দোষীদের চিহ্নিত করে শাস্তির দাবি জানিয়েছেন।
বিজিএমইএ জানিয়েছে, আগুনে পুড়ে যাওয়া আনোয়ার ফ্যাশন কারখানাটি সংগঠনের সদস্য নয়। এটি একটি ওয়াশিং ইউনিট। সংগঠনটি এক বিবৃতিতে নিহতদের প্রতি শোক প্রকাশ ও আহতদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করেছে।
২০১০ সালের নিমতলী ও ২০১৯ সালের চকবাজারের চুড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ডের পর রাসায়নিক গুদামবিষয়ক ঝুঁকি নিয়ে যে সতর্কতা জারি হয়েছিল, রূপনগরের এই অগ্নিকাণ্ড সেই পুরনো বিপদের নতুন প্রমাণ—রাজধানীর জনবহুল এলাকায় রাসায়নিক গুদামের ভয়াবহ বাস্তবতা যেন আবারও স্মরণ করিয়ে দিল।
সিএ/এমআর