জলবায়ু পরিবর্তন যে একটি বাস্তব ও বৈশ্বিক সংকট, তা অ্যান্টার্কটিকার বরফ গলা থেকে শুরু করে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে পানির উচ্চতা বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। ২০২৪ সালে বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা ছিল ১৮৫০ সালের পর সর্বোচ্চ। শিল্পোন্নত দেশগুলো এ পরিস্থিতির প্রধান কারণ হলেও এর বিরূপ প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ছে উন্নয়নশীল দেশগুলোর ওপর। এই অভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সক্রিয় হয়েছে।
২০১৫ সালে জাতিসংঘের শীর্ষ সম্মেলনে গৃহীত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা এবং একই বছরে স্বাক্ষরিত প্যারিস চুক্তির মাধ্যমে বৈশ্বিক উষ্ণতা প্রাক্-শিল্পযুগের তুলনায় ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে সীমিত রাখার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। এর ধারাবাহিকতায় বহু দেশ কার্বননিরপেক্ষতা অর্জনের পথে এগোচ্ছে। বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ জাপানও এই উদ্যোগের বাইরে নয়।
বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমনকারী দেশ জাপান ২০২১ সালে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক অঙ্গীকার ঘোষণা করে। দেশটি ২০৫০ সালের মধ্যে কার্বননিরপেক্ষতা অর্জনের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে এবং ২০৩০ সালের মধ্যে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন ৪৬ শতাংশ কমানোর পরিকল্পনা নিয়েছে। রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের পর জ্বালানি সরবরাহ ও মূল্যসংকট জাপানকে তাদের জ্বালানি কাঠামো পুনর্বিবেচনায় বাধ্য করে। এর প্রেক্ষাপটে ২০২৩ সালে অনুমোদন পায় ‘কার্বনমুক্তকরণ এবং বর্ধনশীল অর্থনৈতিক কাঠামোর জন্য কাঠামোগত রূপান্তর (জিএক্স প্রসার কৌশল)’।
এই কৌশলের আওতায় গ্রিন ট্রান্সফরমেশন বা জিএক্স বাস্তবায়নের জন্য আগামী এক দশকে সরকারি ও বেসরকারি খাত মিলিয়ে প্রায় ১৫০ ট্রিলিয়ন ইয়েন বিনিয়োগের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। ২০২৪ সালে চালু হয় জিএক্স অ্যাক্সিলারেশন এজেন্সি। একই বছরে ফেব্রুয়ারিতে বাজারে ছাড়া হয় বিশ্বের প্রথম সার্বভৌম ট্রানজিশন বন্ড ‘জাপান ক্লাইমেট ট্রানজিশন বন্ড’, যার মাধ্যমে প্রাথমিকভাবে ২০ ট্রিলিয়ন ইয়েন সংগ্রহ করা হয়েছে।
জিএক্স অ্যাক্সিলারেশন এজেন্সির পরিচালক হিদেকি তাকাদা জানিয়েছেন, গবেষণা, নীতিগত সমন্বয় ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগের মাধ্যমে এই সংস্থা জিএক্স হাব হিসেবে কাজ করছে। বেসরকারি বিনিয়োগ ত্বরান্বিত করতে ঋণ নিশ্চয়তা ও ইকুইটি বিনিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। ২০২৬ সাল থেকে নিঃসরণ লেনদেনব্যবস্থা ও কার্বন দর চালুর পরিকল্পনাও রয়েছে।
এই বিশাল বিনিয়োগের বড় অংশ যাচ্ছে জাপানের সর্ব-উত্তরের জেলা হোক্কাইদোতে। প্রাকৃতিক সম্পদ, শীতল আবহাওয়া ও বিস্তীর্ণ ভূমির কারণে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ক্ষেত্রে হোক্কাইদোর সম্ভাবনা জাপানের মধ্যে সর্বোচ্চ। রাজধানী সাপ্পোরোকে কেন্দ্র করে অঞ্চলটিকে জাপানের নবায়নযোগ্য জ্বালানি সরবরাহের ভিত্তি এবং এশিয়ার একটি আর্থিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে জাতীয় প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ২০২৪ সালের জুনে হোক্কাইদোকে জাতীয় কৌশলগত বিশেষ অঞ্চল এবং সাপ্পোরোকে আর্থিক ও সম্পদ ব্যবস্থাপনার বিশেষ অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
বায়ুবিদ্যুৎ, সেমিকন্ডাক্টর, ডেটা সেন্টার ও হাইড্রোজেন জ্বালানিনির্ভর পরিবহনব্যবস্থা—এই চার খাতকে কেন্দ্র করে হোক্কাইদোতে শিল্পগত রূপান্তর এগোচ্ছে। ইশিকারি উপকূলে গড়ে ওঠা জাপানের বৃহত্তম অফশোর বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ২০২৪ সালেই উৎপাদিত হচ্ছে ১ লাখ ১২ হাজার কিলোওয়াট বিদ্যুৎ। সেমিকন্ডাক্টর খাতে ২০৩০ সালের মধ্যে ১০০ ট্রিলিয়ন ইয়েন বিনিয়োগের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, যার বড় অংশ যাবে হোক্কাইদোতে।
ডেটা সেন্টার শিল্পেও হোক্কাইদো হয়ে উঠছে মূল কেন্দ্র। শীতল আবহাওয়ার কারণে কম শক্তিতে তাপ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হওয়ায় এখানে কার্বনমুক্ত ডেটা সেন্টার গড়ে তোলা হচ্ছে। একই সঙ্গে হাইড্রোজেন জ্বালানিনির্ভর পরিবহনব্যবস্থার অংশ হিসেবে সাপ্পোরোতে চালু হয়েছে বাণিজ্যিক হাইড্রোজেন রিফুয়েলিং স্টেশন।
হোক্কাইদো ও সাপ্পোরোকে বিনিয়োগবান্ধব করতে চালু হয়েছে ওয়ান-স্টপ সেবা, ভর্তুকি, কর ছাড় এবং বিদেশি উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষ সহায়তা কাঠামো। ‘টিএসএইচ’ ও ‘স্টেপ’ নামের কাঠামোর মাধ্যমে স্থানীয় সরকার, বিশ্ববিদ্যালয় ও বেসরকারি খাতের মধ্যে সমন্বয় জোরদার করা হয়েছে। পাশাপাশি ‘স্টার্টআপ হোক্কাইদো’ উদ্যোগের মাধ্যমে পরিবেশ, জ্বালানি ও প্রযুক্তিভিত্তিক নতুন উদ্যোক্তাদের সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, হোক্কাইদো-সাপ্পোরোর এই মডেল জাপানকে ২০৫০ সালের কার্বননিরপেক্ষতার পথে এগিয়ে নেবে। একই সঙ্গে এটি এশিয়াসহ বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় একটি কার্যকর উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে, যার পরোক্ষ সুফল পেতে পারে বাংলাদেশের মতো জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোও।
সিএ/জেএইচ


