সংবাদের মূল অংশ
ভারতের সিনেমায় রজনীকান্ত এমন এক নাম, যার উত্থান যেন রূপকথাকেও হার মানায়। ১৯৭৫ সালের শুক্রবার ( ১৫ আগস্ট) মুক্তি পাওয়া কে বালাচন্দর পরিচালিত ‘অপূর্ব রাগাঙ্গাল’–এর একটি ছোট চরিত্র থেকেই শুরু তাঁর যাত্রা। জীর্ণ পোশাক পরা, প্রায় অচেনা এক তরুণ—শিবাজি রাও গায়কোয়াড়। সেই তরুণই পরবর্তী সময়ে রজনীকান্ত নামে হয়ে উঠলেন ভারতীয় চলচ্চিত্রের অন্যতম প্রভাবশালী সুপারস্টার। পাঁচ দশক পেরিয়েও বক্স অফিসে একই দাপটে তিনি এখনও টিকে আছেন। আজ বৃহস্পতিবার ( ১২ ডিসেম্বর) এই অভিনেতার জন্মদিন।
ক্যারিয়ারের শুরুতে রজনীকান্ত নায়ক হিসেবে নয়, বরং খল চরিত্রে জনপ্রিয়তা পান। ‘আভারগল’, ‘১৬ ভায়াথিনিলে’, ‘আড়ু পুলি আট্টাম’, ‘গায়ত্রী’—একটির পর একটি চলচ্চিত্রে তিনি ছিলেন ভীতিজাগানিয়া উপস্থিতি। পরে ১৯৭৭ সালে তেলেগু ছবি ‘চিলাকাম্মা চেপ্পিন্দি’তে প্রথম নায়কের চরিত্রে অভিনয় করেন। একই বছরে ‘ভুবনা ওরু কেলভি কুরি’ তাঁকে এনে দেয় বড় স্বীকৃতি। তবে ১৯৮০ সালে ‘ডন’-এর তামিল রিমেক ‘বিলা’ তাঁকে নিয়ে যায় নতুন উচ্চতায়—ধূসর চরিত্রে অভিনয় করে তিনি হয়ে ওঠেন ব্যতিক্রমী নায়ক।
এরপরের দশক জুড়ে রজনীকান্তের উত্থান ছিল ধাপে ধাপে শক্তিশালী। ‘থালাপতি’, ‘আন্নামালাই’, ‘মুথু’, ‘পদয়াপ্পা’, ‘চন্দ্রমুখী’—এসব চলচ্চিত্র তাঁকে প্রতিষ্ঠা দেয় একাধারে অভিনেতা, সুপারস্টার এবং গণমাধ্যমের প্রিয় মুখ হিসেবে। কখনো ত্রাতা, কখনো সুপারহিরো, আবার কখনো ফিরেছেন ধূসর চরিত্রে—২০০৭ সালের ‘শিবাজি’ তার অন্যতম উদাহরণ।
২০১৬ সালে ‘কাবলি’তে তিনি প্রথমবার নিজের বয়সী লুক নিয়ে হাজির হন—চুল-দাঁড়ি সাদা, মুখে ক্লান্তি, কিন্তু চরিত্রে ছিল প্রবল শক্তি। এরপর ‘কালা’, ‘পেট্টা’, ‘দরবার’, ‘জেলার’, ‘ভেট্টাইয়ান’—প্রতিটি ছবিতেই তিনি দেখিয়েছেন, নায়কও ভুল করতে পারে, দুর্বল হতে পারে, মানবিক হতে পারে।
রজনীকান্তের জনপ্রিয়তার আরেক বড় কারণ—তিনি নিজেকে সবসময় ‘দুর্লভ’ রেখেছেন। অভিনয় জীবনের প্রথম ১০ বছরে তিনি শতাধিক ছবি করলেও পরে বছরে একটি ছবিতেও নেমে আসেন। কোনো পণ্যের বিজ্ঞাপন করেন না, ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকার দেন খুব কম। ভক্তদের কাছে তাঁর উপস্থিতি নিজেই যেন এক বিশেষ ঘটনা।
২০১৪ সালে টুইটারে যোগ দিয়েই রাতারাতি ২ লাখ ১০ হাজার অনুসারী পান তিনি। ২০২৩ সালে ‘জেলার’ বক্স অফিসে ৬০০ কোটির বেশি আয় করে। তিনি হয়ে ওঠেন একমাত্র ভারতীয় অভিনেতা, যার দুটি ছবি ৫০০ কোটির বেশি আয় করেছে। নতুন ছবি ‘কুলি’র জন্য তিনি নাকি পেয়েছেন ২৭০ কোটি রুপি।
রজনীকান্তের ভক্তদের উন্মাদনাও কিংবদন্তি—সিনেমা মুক্তির আগে তাঁর বিশাল কাটআউটে দুধ ঢালা দক্ষিণ ভারতে প্রচলিত রীতি। এ কারণে মাঝে মাঝে স্থানীয়ভাবে দুধের সংকট পর্যন্ত তৈরি হয়েছে। দুধ ব্যবসায়ীরা তাঁকে পর্যন্ত অনুরোধ করেছেন ভক্তদের নিয়ন্ত্রণ করতে।
ব্যক্তিগত জীবনেও রজনীকান্ত সবসময় ছিলেন স্বচ্ছ। পর্দার ইমেজ বাস্তবে আনতে চান না তিনি। কোনো মেকআপ নয়, নেই পরচুলা—সাধারণ পোশাকে জনসমক্ষে হাজির হন। জন্মদিনে ভক্তদের জন্য আয়োজিত অনুষ্ঠানও একসময় বন্ধ করে দেন, কারণ তাঁর অনুষ্ঠান দেখতে যাওয়ার পথে দুর্ঘটনায় কয়েকজন ভক্তের মৃত্যু হয়।
১৯৫০ সালের বৃহস্পতিবার ( ১২ ডিসেম্বর) জন্ম শিবাজি রাও গায়কোয়াড়ের শৈশব ছিল চ্যালেঞ্জে ভরা। মা হারান মাত্র ৯ বছর বয়সে। কখনো অফিস বয়, কখনো কাঠমিস্ত্রি, কখনো কুলি, আবার কখনো বাস কন্ডাক্টর হিসেবে কাজ করেছেন। তাঁর টিকিট দেওয়া এবং খুচরা ফেরানোর ভঙ্গিতে ভক্তরা এতটাই মুগ্ধ ছিলেন যে অনেকে তাঁর বাসের জন্য অপেক্ষা করতেন। পরে বন্ধুর সহায়তায় ভর্তি হন মাদ্রাজ ফিল্ম ইনস্টিটিউটে, যেখানে পরিচালক কে বালাচন্দর তাঁকে নতুন নাম দেন—রজনীকান্ত।
সংলাপ বলার ধরণ, ছোট ছোট বিরতি, তীক্ষ্ণ চোখ, আর ক্যামেরার সামনে বিশেষ ভঙ্গিমা—সব মিলিয়ে তিনি বানিয়ে ফেলেছিলেন নিজের আলাদা পরিচয়। ভারত সরকার তাঁকে পদ্মভূষণ (২০০০), পদ্মবিভূষণ (২০১৬) এবং দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার (২০১৯) প্রদান করে।
সম্প্রতি ‘কুলি’ ছবির প্রচারে এসে নিজের সংগ্রামের স্মৃতি মনে করে আবেগতাড়িত হন তিনি। বলেন, ‘কুলি হয়ে কাজ করার সময় অনেকবার অপমান সহ্য করেছি। একদিন এক ভদ্রলোক আমাকে দুই রুপি দিয়ে বলল, ওর লাগেজ টেম্পোতে তুলে দিতে। কণ্ঠটা কেমন যেন চেনা লাগছিল। পরে বুঝি, সে আমার কলেজের বন্ধু! আমি একসময় ওকে নিয়ে অনেক হাসাহাসি করতাম। সেদিন জীবনে প্রথমবার আমি কেঁদে ফেলেছিলাম।’
নতুন ছবি ‘কুলি’ এখনো আলোচনার কেন্দ্রে। গত বছরের শনিবার ( ৫ জুলাই) শুটিং শুরু হয়ে এবছরের সোমবার ( ১৭ মার্চ) শেষ হয়। প্রায় সাড়ে ৩০০ কোটি রুপি বাজেটের এই অ্যাকশন-ড্রামায় রজনীকান্তের সঙ্গে রয়েছে আমির খান, নাগার্জুনা, উপেন্দ্র, সত্যরাজ ও শ্রুতি হাসান। স্বর্ণ পাচারের গল্পে তৈরি এই সিনেমা মুক্তির পর প্রশংসা কুড়িয়েছে সমালোচকদের।
সিএ/এএ


