বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সাড়ে চার মাস পর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ঘটে যায় এক গুরুত্বপূর্ণ মোড়। ১৯৭১ সালের ৯ আগস্ট স্বাক্ষরিত ভারত–সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তি মুক্তিযুদ্ধের কূটনৈতিক ও সামরিক পরিস্থিতিকে নতুনভাবে সাজিয়ে দেয়। এই চুক্তির মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়া শক্তিগুলোর মধ্যে তৈরি হয় নতুন মেরুকরণ, যা বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পথকে আরও সুগম করে তোলে।
চুক্তির পেছনের প্রেক্ষাপট
হাসান ফেরদৌস তাঁর মুক্তিযুদ্ধে সোভিয়েত বন্ধুরা বইয়ে উল্লেখ করেছেন—চুক্তিটি আকস্মিক মনে হলেও দুই বছরের বেশি সময় ধরে এর আলোচনাপর্ব চলছিল। তবে আন্তর্জাতিক রাজনীতির দ্রুত পরিবর্তন শেষ পর্যন্ত চুক্তি স্বাক্ষরকে ত্বরান্বিত করে।
১৯৭১ সালের জুলাইয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ এশিয়া নীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসে। পাকিস্তানের সহযোগিতায় মার্কিন নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জারের চীন সফরের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র–চীন সম্পর্ক উষ্ণ হতে শুরু করে। চীন ও যুক্তরাষ্ট্র আগে থেকেই পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নেওয়ায় ভারতের নিরাপত্তাজনিত শঙ্কা বাড়তে থাকে।
ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, পাকিস্তানের সঙ্গে সম্ভাব্য সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভর করা যাবে না। ফলে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে মৈত্রী চুক্তি ভারতের জন্য নিরাপত্তার অন্যতম প্রধান ভরসা হয়ে ওঠে।
চুক্তি স্বাক্ষর ও মূল ধারা
৮ আগস্ট সোভিয়েত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আঁদ্রেই গ্রোমিকোর আকস্মিক দিল্লি সফরের পরদিন—৯ আগস্ট—ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং ও গ্রোমিকো ২০ বছর মেয়াদি এই চুক্তি স্বাক্ষর করেন।
চুক্তির তিনটি ধারা ভারতের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল—
দুই দেশ পরস্পরের বিরুদ্ধে কোনো সামরিক জোটে যুক্ত হবে না।
তৃতীয় পক্ষ যেন দুই দেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করতে না পারে—এ বিষয়ে উভয়ের কঠোর প্রতিশ্রুতি।
নিরাপত্তা হুমকির মুখে উভয় দেশ অবিলম্বে আলোচনা শুরু করবে।
এই শেষ ধারাটিকে বিশ্লেষকরা ‘নিরাপত্তা রক্ষাকবচ’ হিসেবে অভিহিত করেছেন।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
চুক্তির সংবাদ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ‘বিস্ময়কর’ হিসেবে দেখা হয়। কিসিঞ্জার তাঁর দ্য হোয়াইট হাউস ইয়ার্স বইয়ে এটিকে ‘বোমা বিস্ফোরণের’ মতো ঘটনা বলে উল্লেখ করেছেন। পাকিস্তানে তো বিরাট তোলপাড়ই শুরু হয়।
বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারও এটিকে স্বাগত জানায়, কারণ এতে ভারতের সামরিক সহায়তা পাওয়ার সম্ভাবনা আরও জোরালো হয়ে ওঠে।
মুক্তিযুদ্ধে প্রভাব
চুক্তির পর ভারত আরও দৃঢ়ভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে দাঁড়াতে শুরু করে।
অস্ত্র সংগ্রহ সহজ হয়,
প্রশিক্ষণ কেন্দ্র বাড়ে,
সামরিক প্রস্তুতি ত্বরান্বিত হয়।
এদিকে পাকিস্তান পরিস্থিতি সামাল দিতে মস্কোতে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালালেও সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের অবস্থান পরিষ্কার করে দেয়—রাজনৈতিক সমাধান ছাড়া সংকট কাটবে না।
অক্টোবর–নভেম্বরে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে ধারাবাহিক উচ্চপর্যায়ের বৈঠকের মাধ্যমে চুক্তির ভিত্তি আরও সুদৃঢ় হয়। সোভিয়েত যুদ্ধমন্ত্রী গ্রেচকো পরিষ্কার জানান—চুক্তির প্রতিটি ধারা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা হবে।
শেষকথা
মৈত্রী চুক্তি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আন্তর্জাতিক ভারসাম্য পাল্টে দেয়। পাকিস্তান–চীন–যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য যৌথ প্রতিক্রিয়ার ঝুঁকি কমে আসে, আর ভারত আরও আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে প্রত্যক্ষ সহায়তা বাড়ায়।
এভাবেই এই চুক্তি মুক্তিযুদ্ধকে দ্রুত বিজয়ের পথে এগিয়ে নিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
তথ্যসূত্র:
১. হাসান ফেরদৌস, মুক্তিযুদ্ধে সোভিয়েত বন্ধুরা (২০১৩)
২. মঈদুল হাসান, মূলধারা ’৭১ (২০০৮)
৩. হেনরি কিসিঞ্জার, দ্য হোয়াইট হাউস ইয়ার্স (১৯৭৯)
৪. সুলতান মুহাম্মদ খান, মেমোরিজ অ্যান্ড রিফ্লেকশনস অব আ পাকিস্তানি ডিপ্লোম্যাট (১৯৯৭)
সিএ/এএ


