জুবায়ের খান
Date- 9 April, 2003
আমি তিথি ।
ক্লাস নাইনে পড়ি । আমার বয়স পনেরো । খুব সুন্দর করে কিভাবে ডায়েরি লিখতে হয় তা আমি জানিনা কিন্তু লিখছি কারণ যে কথাগুলো কাউকে বলে শান্তি পাওয়া যায়না সেগুলো লিখে শান্তি । ডায়েরিতে কিছু লিখা মানে নিজের সাথেই নিজে কথা বলা । আমি আমার সাথেই কথা বলছি । এই কথাগুলো আমি আমার মায়ের কাছে শুনেছি । আম্মু প্রায়ই বলতেন কোন মানুষ কে বিশ্বাস করে কিছু বলার চেয়ে ডায়েরি লেখা ভালো কারণ মানুষ বিশ্বাস ঘাতকতা করতে পারে কিন্তু ডায়েরি তা পারেনা । আজ আম্মুকে খুব মিস করছি । প্রায় একমাস হলো মা মারা গেছেন তবুও কেন যেন বিশ্বাস হচ্ছে না । মনে হচ্ছে এখনই আম্মু বলে ডাক দিলে মা পিছন থেকে সাড়া দিবেন । আর আমি বলবো, আম্মু কই ছিলে এতদিন ? তুমি জানো ? তিতলুটা আমাকে এই কয়েকদিন খুব বিরক্ত করেছে । খাবার খেতে চাচ্ছে না । আব্বু ফল এনে দিয়েছে তবুও খেতে চায় না । সারাদিন আম্মু যাব আম্মু যাব বলতে থাকে । তুমি চলে আসো আম্মু তুমি চলে আসো । ইশশ সত্যিই যদি আম্মু আমার এই আবেদন শুনে চলে আসতো ?
আব্বু এ কয়েকদিন কেমন কেমন যেন হয়ে গেছেন । খুব বেশি কথা বলেন না । খালি আমার আর তিতলুর দিকে তাঁকিয়ে থাকেন । আব্বুকে দেখতে খুব অসহায় লাগে । মন বলে আব্বুর সাথে বসে কিছুক্ষন গল্প করি কিন্তু পারিনা । কোনো এক অজানা জড়তা মনে এসে ভির করে।
প্রথম পৃষ্ঠা পড়ে তিতলু বড় একটা ধাক্কা খেল । চিঠিতে মেয়েটির ছোট ভাইয়ের নাম তিতলু । তার নিজের নামও তিতলু । ছবিতেও দুজনের যথেষ্ঠ মিল । তিতলু নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করলো, তাহলে কি তিথি আমার বোন ?
তিতলুর কাছে সবকিছু অগোছালো লাগতে শুরু করেছে । সে বিশ্বাস করে উঠতে পারছে না যে তার এক বোন আছে । বোন আছে ভাবতে তিতলুর হালকা ভালোও লাগছে আবার ভয়ও লাগছে । তিতলু ডায়েরিটি নিয়ে বিছানায় বসে পড়লো । তাড়াহুরো করে পৃষ্ঠা উল্টিয়ে দেখলো আরো একটি দিনলিপি ।
20 April , 2003
আজ খুব সকালেই আব্বু বাহিরে গিয়েছেন । দুপুর গড়িয়ে বিকেল, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা । আর এখন রাত । আব্বু বাসায় ফেরেন নি । আমার খুব টেনশন হচ্ছে । আব্বু কখনই বাসায় ফিরতে এতো দেরি করেন না । আর ফুফুর বাসায় উঠার পর তো তা একেবারেই না । একটু আগে ফুফু বিলাপ করে খুব জোরে জোরে কেঁদে বলেছেন, তিথিরে !! না জানি তোদের কপালে কি আছে । মা মরে তো বেঁচে গেছে । বাবারও কোনো খোজ নাই । তোদের কি হবে রে তোদের কি হবে …
তিতলু বারান্দায় একা একা খেলছে । ওর কোনো টেনশন নেই, কোনো বিরক্ত নেই । ইশশ বাচ্চা হওয়ার কত সুবিধা না ? চারপাশে কি হচ্ছে তা নিয়ে কোনো মাথাব্যাথা থাকে না । তিতলুটার উপরে আমার হিংসাই হচ্ছে । সময় যত গড়াচ্ছে আমার টেনশন ততই বাড়ছে । আমি এখন ঘুমাতে যাব । আশা করি আব্বু রাতের মধ্যে চলে আসবেন ।
এখন সকাল দশটা । সারারাত ঘুম হয়নি । টেনশনে কার ঘুম আসে ? রাত ভরে যত আজে বাজে কল্পনা মনে ঘুরে বেড়িয়েছে । আব্বু যদি চলে যায় আমাদের একা ছেড়ে আম্মুর মত ? পুরো রাত জেগে জেগে আব্বুর জন্য অপেক্ষা করেছিলাম ।
সকাল হলেও আব্বু আসলেন না । আমার কান্না পাচ্ছে । তিতলুটা আবার ঘুমিয়েছে ।
আজ পাঁচদিন হলো আব্বুর কোনো খবর নেই । বাবার জন্য বুকের ভেতর টা হু হু করছে । তিতলুটা আধো আধো মুখে বলে, তিতিপু তিতিপু আবু যাবো । প্রতিরাতে আমার কান্না পায় । আব্বু কি তাহলে মায়ের মতই চলে গেলেন ? ফুফুর কথাও শুনতে আর ভালো লাগে না । গতকাল বললেন, মনে হয়না তোদের বাবা আর কখনও ফিরে আসবেন । দেনাদার রা ধরে নিয়ে মেরেই ফেলেছে নাকি দেনার ভয়ে সে দেশান্তরই হয়েছে কে জানে । আমি গরীব মানুষ, তোদের কিভাবে পালবো ? আমারও তো সংসার আছে ।
খুব অবাক লাগছে এই ভেবে যে এই ফুফুই সেই রাতে বাবার জন্য এতো কেঁদেছেন । হঠাৎ করেই বদলে গেলেন । তার দূর্বলতা প্রকাশ করে আমাদের কে বিদায় দিতে চাইছেন ।
সপ্তাহ পার হয়ে গেলো আব্বু বাসায় আসলেন না । দেনাদার রা আগেও এসে বাবার খোজ করতো কিন্তু এখন রোজ এসে বাবার খোজ করেন । আমাদের জন্য সামনে খারাপ কিছু একটা অপেক্ষা করছে আমি নিশ্চিত।
তিতলুটা কলিং বেলের শব্দ পেলেই দরজার দিকে ছুটে যায় । ছুটে যাওয়ার সময় খালি বলতে থাকে বাবা এসেছে বাবা এসেছে । দরজা খোলার পর বাবাকে না পেলে কেঁদে উঠে । ওর কান্না দেখে আমারও কান্না পায়। দেনাদার রা আগেই আমাদের বাড়ি দখল করেছে তবুও বাবার খোজ করে যান । তাঁদের কাছে বাবার খোজের ব্যাপারে জিজ্ঞাস করলে বলে, তোর বাপ কই ? সত্য কইরা বল ! নাইলে পুলিশ নিয়া আমু ঘরে।
ফুফা প্রায়ই রাগারাগি করেন । তিনি এখন আমাদের বোঝা মনে করেন ।
তিতলু পরপর অনেকগুলো পৃষ্ঠা পড়লো । চোখে এখন তার অশ্রু জমে গেছে । বেসিন থেকে মুখ ধুয়ে সে আবার ডায়েরি নিয়ে বসে পরবর্তী পৃষ্ঠা পড়ে ।
27 May, 2003
আমি এখন তিতলুকে নিয়ে পাড়ার এক চাচির ঘরে উঠেছি । চাচি বস্তিতে থাকেন । ফুফার রাগ যখন চরমে উঠেছিল তখন তিনি ফুফুকে দিয়ে বলিয়েছেন যেন আমরা চলে যাই । ফুফুই এই চাচির বাসায় দিয়ে গেছেন । চাচিকে তিনি বলে গেছেন প্রতিমাসে আমাদের মাসিক খরচ দিয়ে যাবেন । চাচি সেই শর্তে আমাদের থাকতে দিতে রাজি হন । মাস শেষ হয়েছে অনেকদিন হলো কিন্তু ফুফু আর আসেন না ।
তিতলুটা প্রতিরাতে আমার বুকের উপর উঠে জড়িয়ে ধরে এমন ভাবে শুয়ে থাকে যেন ওকে কেউ আলাদা করতে পারবে না।
চলবে…