ইভান পাল
অ্যা! এ কেমন বিশ্ববিদ্যালয় আবার!
যেখানে পড়তে হলে ফেইল করা লাগে। এই পৃথিবীর সকল মানবজাতি ই জানেন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে হলে আগে পরীক্ষায় পাস করতে হয়। কিন্তু, ফেইল! মানে যাকে সোজা বাংলায় বলে “অকৃতকার্য”। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে হলে অকৃতকার্য হতে হবে?
লেখকের মাথা-মুন্ডু সব ঠিক আছে তো? নাকি সব গেলো?
হ্যাঁ, আমি জানি উপরের এই উক্তি গুলো আমার প্রিয় পাঠকগণ সামনাসামনি না হলেও মনে মনে ঠিক ই বলছেন। কারণ, এই প্রবন্ধের শিরোনাম ই যে বাস্তবিক থেকে একটু বাইরে, একটু ভিন্ন কিংবা একটু অদ্ভুত!
তবে আমি আমার প্রিয় পাঠকদের শতভাগ নিশ্চয়তা দিয়ে বলছি—
প্রিয় পাঠক, আপনাদের এই ভালোবাসার লেখকটির অবশ্যই মাথা-মুন্ডু সবই ঠিক আছে। আর আমাদের এই পৃথিবী তে, আমাদের আশেপাশে এবং আমাদের এই এশিয়া মহাদেশেই রয়েছে এরকম ই একটি বিশ্ববিদ্যালয়। যার গল্পই আজ আপনাদের বলবো।
আচ্ছা, আপনাদের মিস্টার পারফেকশনিস্ট মানে আমির খান অভিনীত সেই বিখ্যাত মুভিটার কথা মনে আছে? ২০০৯ সালে যেটা বক্স অফিস হিট করেছিলো।
আরে যে মুভিটাকে বলা হয়ে থাকে—
The most loved film of the decade.
কোন মুভিটা বলুন তো?
আশা করি পাঠকমহল কিছুটা হলেও আচঁ করতে পেরেছেন আমি কোন মুভিটার কথা বলছি।।
মুভিটি — “থ্রি ইডিয়টস”।।

আমি জানি আপনারা এই মুভিটির নাম শুনেই দু থেকে তিনটি লম্প-ঝম্প করে ফেলেছেন। কারণ, এটি হচ্ছে প্রত্যেকটি মুভি পাগল মানুষের জন্য একটি সেরা মুভি। থ্রি ইডিয়টস দেখেন নি এরকম মানুষের সংখ্যা বোধ হয় খুব একটা খুঁজেই পাওয়া যাবে না।
থ্রি ইডিয়টস হচ্ছে আমির অভিনীত সব থেকে সেরা একটি মুভি। ২০০৯ সালে মুক্তি পাওয়া এই মুভিটি সমালোচকদের দৃষ্টিতে শ্রেষ্ট মুভি বলে সমাদৃত হয়। আর এখনো এই মুভিটি সমানভাবে জনপ্রিয় দর্শকদের কাছে।
আর এই মুভির সাথে এই প্রবন্ধ কিংবা সেই ফেইলের বিশ্ববিদ্যালয় এর বা কি সম্পর্ক এটি প্রিয় পাঠকদের মনে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগতেই পারে।
কারণ, সে ফেইলের বিশ্ববিদ্যালয়ের উৎপত্তি কিন্তু এই থ্রি ইডিয়টস মুভি থেকে। আজ্ঞে হ্যাঁ প্রিয় পাঠক। আর তার জন্যই আপনাদের আগে একটু থ্রি ইডিয়টস মুভির গল্পে নিয়ে যেতে চাই।।
শুনুন তবে—-
থ্রি ইডিয়টস মুভি’র গল্পে যায় আমরা একটু—
রাজকুমার হিরানী পরিচালিত এবং বিধু বিনোদ চোপড়া প্রযোজিত থ্রি ইডিয়টস মুভিটিতে অভিনয় করেছেন— আমির খান, কারিনা কাপুর, আর. মাধবন এবং শরমান যোশি। আর বক্স অফিসে হিট করা এই মুভিটির চিত্রনাট্য লিখেছেন অভিজাত যোশি।
তো, এই মুভিটির গল্পটি যদিও বা আমরা সব্বাই ই জানি। তারপর ও আপনাদের জন্য আরেকটু ভেঙ্গে লিখছি।
দেশসেরা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ইম্পেরিয়াল কলেজ অব ইঞ্জিনিয়ারিং এর প্রাক্তন দুই ছাত্র, ফারহান কুরেশী এবং রাজু রাস্তোগী দশ বছর পর একটা ফোনকল পেয়ে ফিরে আসে তাদের প্রিয় ক্যাম্পাসে। আর ফোন কলটি করে তাদের ই এক পুরোনো সহপাঠী। যার নাম চতুর রামলিঙ্গম। চতুর মূলত ফোন কলটি করেছিল একটাই উদ্দেশ্যে। আর তা হলো,— থ্রি ইডিয়টসদের স্মরণ করিয়ে দেওয়া দশ বছর পুরোনো এক চ্যালেঞ্জ কে । বর্তমানে প্রচুর অর্থবিত্তের মালিক চতুর রামলিঙ্গম ওরফে সাইলেন্সার জানতে চায়, কেমন আছে তার ভার্সিটি লাইফের চ্যালেঞ্জ করা সেই থ্রী ইডিয়টসরা?
যাক সম্পূর্ণ মুভিটা নিয়ে লিখছি না কারণ যেহেতু এই মুভির আদ্যোপান্ত আমাদের সবারই জানা, তাই খুব সংক্ষেপ করছি।
মূলত: এই মুভিটিতে আমরা দেখতে পাই, ভার্সিটির ডিন ভীরু সাহাস্ত্রাবুদ্দকে ( যাকে তারা সবাই “ভাইরাস” নামে ডাকতেন )। যিনি কঠোর অনুশাসনের আর পুঁথিগত বিদ্যার কবলে তার বিশ্ববিদ্যালয়কে ছাত্রদের জন্যে করে রেখেছেন এক নিরানন্দের জায়গা। যেখানে পড়াশুনা র জন্য বইয়ের মুখস্থ বিদ্যায় সব।
কিন্তু, পরবর্তীতে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ছাত্র ভর্তি হয়। যিনি ই এই মুভিটির কেন্দ্রীয় চরিত্র। যার নাম হচ্ছে— রাঞ্ছোরদাস শ্যামল দাস ছ্যাচাড় কিংবা ছোটে কিংবা ফুংসুক ওয়াংডু। আর এই চরিত্রতেই অভিনয় করেন আমির খান।
তো, এতে দেখা যায় রাঞ্চো মানে আমির খান ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তো পারিবারিক জোর জবরদস্তিতে নয় বরং ভালবেসে। বিভিন্ন যন্ত্রপাতির প্রতি তার আগ্রহের কমতি ছিল না। সে বিশ্বাস করতো, ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে সফল হতে হলে এর বাস্তব প্রয়োগ ঘটাতে হবে। শুধুমাত্র পাঠ্যবই এবং ক্লাসে স্যারের লেকচারগুলো ভালভাবে না বুঝে শুধু মুখস্ত করলেই ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে সাফল্য আসবে না।
তার কথা ছিলো— সফল হতে হলে, সফলতা নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে উৎকর্ষের পেছনে ছোটা উচিত, তাহলে সফলতা এমনিতেই চলে আসবে।
আর এই মুভিটি একটা বিষয় খুব পরিষ্কারভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়। আর তা হচ্ছে— নিজের মন যেটা বলে তাতেই আমাদের ইতিবাচক ভাবে সাড়া দেওয়া উচিত। শুধুমাত্র কে কি ভাবল বা অন্যের কথা চিন্তা করে কিংবা আরেকজন যে কাজ টা করল আমাকেও নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে সে কাজ টাই করতে হবে তা কিন্তু একে বারেই নয়।
তাই, মুভিটিতে দেখা যায় ফারহানের ইচ্ছে ছিল সে ফটোগ্রাফার হবে, কিন্তু সেই স্বপ্নকে জলাঞ্জলি দিয়ে বাবার ইচ্ছা পূরণ করতে সে ইঞ্জিরিয়ারিংয়ে ভর্তি হয়। রাজুর স্বপ্ন সে পড়াশোনা করে বড় চাকরী করবে এবং পরিবারের দরিদ্রতা দূর করবে। এরকমই কিছু ব্যাপার।
তো, শেষ পর্যন্ত আমরা দেখি যে মুভিটির যে কেন্দ্রীয় চরিত্র রাঞ্ছোরদাস শ্যামল দাস ছ্যাচাড় মানে আমিরখান একটা স্কুল তৈরি করে ভারতের লাদাখ অঞ্চলে। তাতে দেখা যায় শিক্ষার্থীরা সব হাতে কলমে শিখে বাস্তব জীবনের সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করে এবং সফল হয়। সাইকেলে যে পাম্প সরবরাহ করবার মেশিন তা দিয়ে কিভাবে ভেড়ার পশম সংগ্রহ করা হয়। এরকম আরো অনেক কিছু যা আমাদের বাস্তব জীবনের সাথে স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে সম্পর্কিত।।
তো,২০০৯ সালে কিংবা এখনো এই মুভিটি দেখার পর দশর্কদের মনে শুধু একটাই প্রশ্ন ছিলো এবং আজো আছে হয়তো আসলেই কি এরকম স্কুল আছে আমাদের এই আশপাশে কিংবা আমাদের এই ভারত উপমহাদেশে কিংবা এই এশিয়া তে?
প্রিয় পাঠক কিংবা এই মুভিটির দর্শক যারা আছেন আপনাদের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি যে, আপনারা থ্রি ইডিয়টস মুভিতে যে স্কুল টি দেখেছিলেন তা কোনভাবেই কাল্পনিক স্কুল নয়। এটি অবশ্যই একটি বাস্তবিক স্কুল এবং থ্রি ইডিয়টস মুভিটির শেষাংশ টি ঐ স্কুল, স্কুল এলাকাতেই ধারণ করা হয়েছিল। অর্থাৎ লাদাখ এলাকাতে।।
আর, উপরের শিরোনামে যে বললাম— University of Failures: যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে হলে ফেইল করা আবশ্যক।
লাদাখ অঞ্চলের এটিই হচ্ছে সেই স্কুল কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়। যেখানে থ্রি ইডিয়টস মুভিটির শেষাংশের দৃশ্যগুলো ধারণ করা হয়েছিল।
এবার আসি লাদাখের কথায়।
লাদাখ:

ভারতেরই জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের অন্তর্গত একটি এলাকা। যার উত্তরে হচ্ছে~ কুনলুন পর্বতমালা এবং দক্ষিণে হিমালয় দ্বারা বেষ্টিত একটি অঞ্চল।
এই এলাকার অধিবাসীরা ইন্দো-আর্য এবং তিব্বতী বংশোদ্ভুত। লাদাখ কাশ্মীরের সবচেয়ে জনবিরল এলাকা।
ঐতিহাসিককাল ধরে বালুচিস্তান উপত্যকা, সিন্ধু নদ উপত্যকা, জাংস্কার, লাহুল ও স্পিটি, রুদোক ও গুজ সহ আকসাই চিন এবং নুব্রা উপত্যকা লাদাখের অংশ ছিল। বর্তমানে অবশ্য লাদাখ শুধুমাত্র জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের লেহ জেলা ও কার্গিল জেলা নিয়ে গঠিত। লাদাখ তিব্বতী সংস্কৃতি দ্বারা প্রচন্ডভাবে প্রভাবিত। আর তাই একে “ক্ষুদ্র তিব্বত” ও বলা হয়ে থাকে।
(সূত্র: উইকিপিডিয়া)
এই লাদাখে বেশিরভাগ টা সময় ই বরফে ঢাকা থাকে। রাস্তাঘাট পর্যন্ত বরফে ঢেকে যায়। বরফ কেটে তারপর যাওয়া আসা করবার মতো রাস্তা করে নিতে হয়। আর সকালবেলা সূর্য উকিঁ দিলেও রাতের দিকে প্রচণ্ড ঠান্ডা পড়ে। বেশিরভাগ টা সময় ই এখানে তাপমাত্রা মাইনাসে থাকে।
এবারে আসি সেই বিশ্ববিদ্যালয়টির অবস্থান নিয়ে। আমরা এটিকে বিশ্ববিদ্যালয় বললেও এটি কিন্তু তাদের ভাষায়, একটি স্কুল। তাই আজকের জন্য আমরা এটিকে স্কুল ই বলি।
তবে এই স্কুল টি মূলত: আমাদের দেশে যেরকম সব কারিগরি স্কুল / কলেজ রয়েছে এটি ও সেরকম ই একটি স্কুল।
এই স্কুলটি লাদাখের প্রধান শহর লেহ শহর থেকে মাত্র ২০ কিলোমিটার দূরে ফেই নামে একটি গ্রামে অবস্থিত। মূলত: লাদাখ একটি দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চল আর বেশিরভাগ টা সময় ই এটি বরফে ঢাকা থাকে। তাই এই দুর্গম পাহাড়ি এলাকার ছোট ছোট শিশুদের কিংবা এখানকার স্থানীয় জনগোষ্ঠীর শিক্ষা সংস্কারের লক্ষ্যে 1988 সালে সোনাম ওয়াংচুক নামের এক ইঞ্জিনিয়ার ও লাদাখীদের একটি দল ভিন্নধর্মী এই স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেছিল। এটি একটি আবাসিক স্কুল।

SECMOL মূলত সোনাম ওয়াংচুকেরই প্রতিষ্ঠিত এটি একটি সংগঠন। এই সংগঠনটির পুরো নাম Students Educational and Cultural Movement of Ladakh (SECMOL)। আর এই সংগঠনের হাত ধরেই তিনি লাদাখের শিক্ষা প্রসারের জন্য খুলে ফেললেন সেকমল অল্টারনেটিভ স্কুল নামে চমৎকার এক বিদ্যালয়।
আর লাদাখের নেতৃস্থানীয় শিক্ষাকে সংস্কারের ধারণা দিয়েই এই স্কুলটি যাত্রা শুরু করেছে। এসইসিএমওএল ( SECMOL) স্কুলের শিক্ষার্থীদের শেখার জন্য বিভিন্ন ধরনের চিত্তাকর্ষক উপায় রয়েছে।
এই স্কুলটির মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে—
সেখানে লেখাপড়া মানে শুধুমাত্র পুঁথিগত বিদ্যা নয়। সেখানে শিক্ষা মানে বাস্তবকে চেনা, বাস্তব জ্ঞানকে সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে জীবনকে সঠিকভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।
ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার তো অনেকেই হন। কিন্তু শিক্ষা-দীক্ষা সব মিলিয়ে জীবনে সঠিকভাবে মানুষই বা ক’জন হতে পারেন।
মানুষের জীবনে পেশাগত সাফল্য আসলেই যে সে মানুষ প্রকৃত মানুষ হবেন, তেমনটা মনে করবার কিন্তু কোনও কারণ নেই।
মূলত: বাস্তব জীবনের শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে ব্যাক বেঞ্চারদের ফার্স্ট বেঞ্চার করার চেষ্টাই করেন এই স্কুলটির প্রতিষ্ঠাতা সোনাম ওয়াংচুক।

তিনি মনে করেন, আজকালকার যুগের শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের একটাই কথা। আর তা হচ্ছে— পরীক্ষায় ফার্স্ট হতেই হবে। আর কিছুর দরকার নেই। অভিভাবকদের এই কথাই মনে হয়, তাদের সন্তানরা শুধুমাত্র স্কুল-কলেজের পরীক্ষাগুলোতে ১ম, ২য় হলেই চলবে।
ব্যাস, আর কিচ্ছুর প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন নেই বাস্তবিক জ্ঞানের, প্রয়োজন নেই হাতে কলমের শিক্ষার। শুধু মুখস্থ আর ঠোটস্থ করলেই, পরীক্ষায় পাস করলেই জীবনে সন্তান বুঝি মানুষ হয়ে গেলো।
কিন্তু, আসলেই কি জীবন মানে তাই? আর তাই তিনি এই প্রথাগত বিদ্যাকে কিংবা শিক্ষা পদ্ধতিকে খানিক বদলাতে চান।
তারঁ কথা শুনে একটা প্রবাদ ভীষণ মনে পড়ছে।।
“গ্রন্থগত বিদ্যা আর পরহস্তে ধন
নহে বিদ্যা নহে ধন হলে প্রয়োজন”।
জ্ঞান অর্জনের পর তা যদি বাস্তবিক জীবনে কাজেই লাগাতে না পারি তাহলে সব টাই বৃথা। মূলত: এটিই সেই স্কুলটির প্রতিষ্ঠাতা সোনাম ওয়াংচুকের মূল বক্তব্য। আর তার জন্যই তারঁ এই ব্যাতিক্রম ধর্মী স্কুলটির প্রতিষ্ঠা করা।
আমাদের বাঙ্গালিদের মধ্যে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কিন্তু ক্লাসরুম শিক্ষার বাইরে গিয়েও যে কিছু হয়, কিছু শেখা যায় সেটা দেখিয়ে দিয়েছিলেন। আর তারঁ দেখানো সেই পথেই যেন এগিয়ে চলেছেন এই অবাঙ্গালী সুদুর লাদাখের আধুনিক শিক্ষার পথিকৃত সোনাম ওয়াচুক। তাকেঁ লাদাখের শিক্ষা সংস্কারক ও কিন্তু বলা চলে।
SECMOL স্কুলটির শিক্ষার্থীদের পাঠ্যক্রমটি এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে যে তারা যেনো ‘স্ব-শিক্ষা’ কি তা বুঝতে পারে এবং নিজেরা নিজেদের কেই স্ব-শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে পারে।
১৯৮৮ সালে সোনাম ওয়াচুকের নেওয়া এ উদ্যোগে তিনি সেদিন পাশে পেয়েছিলেন লাদাখের সরকার এবং স্থানীয় জনগণকে। আর সকলের সম্মিলিত এই প্রজেক্টটির নাম দেওয়া হয়েছিল~ “অপারেশন নিউ হোপ”।
আর সেদিন থেকে লাদাখে গড়ে উঠল দারুণ এক সামাজিক আন্দোলনের। বাবা-মাকে সচেতন করা, বিজ্ঞান নিয়ে প্রচুর পড়াশোনা করা, প্রচুর ঘাটাঘাটি করা ও বইকে ভালোবাসতে শেখানো, ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াশোনায় উৎসাহী করা ইত্যাদি নিয়ে ক্যাম্পেইন করেছেন এই দলটি।
SECMOL এর গৃহীত এই ‘নিউ হোপ’ প্রজেক্ট টি অবশেষে সফলতা পায়।
১৯৯৬ সালে লাদাখের পাশের হার ৫% থেকে ২০০৯ সালে গিয়ে ঠেকলো ৭৫% এ। এটি ছিলো এই সংগঠন টির জন্য এবং সমগ্র লাদাখ বাসীর জন্য অন্যতম একটি সেরা সাফল্য।
যেখানে লাদাখ হচ্ছে একটি তুষার আবৃত অঞ্চল। বছরের বেশিরভাগ টা সময় ই যেখানে তুষারে আবৃত থাকে, যে অঞ্চলের কচিকাঁচারা সঠিক ভাবে পড়াশোনা করতে পারছে না, সেখানে এই স্কুল টি বিশাল এক পরিবর্তন এনে দিল।
আর স্কুলটিতে এই বরফ ব্যবহার করে স্কুলের পাশেই বানানো হয়েছে আইস হকি মাঠ। যেখানে বরফের জন্য খেলাধুলা করা মুশকিল সাধ্য কাজ সেখানে এই বরফকেই কাজে লাগিয়ে বানানো হয়েছে হকি খেলার মাঠ। সোজা কথা!
লাদাখে গত ৬ দশক ধরে কেবল ছেলেরাই খেলত আইস হকি। সেকমল স্কুলের আইস-টার্ফে মেয়েরাও এখন এই খেলায় পারদর্শী ।
আর এই আইস হকিতে জাতীয় পর্যায়ে মেয়েদের স্কুল টিম চ্যাম্পিয়নও হয়েছে।
আর সবচেয়ে উল্লেখ্যযোগ্য ঘটনা হচ্ছে, ২০১৬ সালে এখানকার দলটিই ভারতের অন্যান্য রাজ্যের দলগুলোকে হারিয়ে জাতীয় মহিলা দল হিসেবে তাইওয়ানে অনুষ্ঠিত এশিয়ান চ্যালেঞ্জ কাপে অংশ নেয়।
আর ২০২১ সালের মধ্যে হকিতে এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্বের খেতাব অর্জনের লক্ষ্য ঠিক করেছে সোনাম প্রতিষ্ঠিত এই বিদ্যালয়টি।
স্কুলটা নিয়ে আরেকটি মজার তথ্য প্রিয় পাঠক আপনাদের জন্য।
শুনুন তবে—-
সাধারণত আমরা যারা পড়াশুনার সাথে জড়িত অর্থাৎ আমরা যারা শিক্ষার্থীরা রয়েছি , আমরা ছোটবেলা থেকেই আশায় থাকতাম কিংবা আজো আশায় থাকি, কবে আমাদের স্কুল ছুটি হবে আর আমরা বাড়ি যাব।।
আর এই স্কুলের ক্ষেত্রে মজার ব্যাপার হচ্ছে—
এই স্কুলের বড় শাস্তিই হলো এক সপ্তাহের জন্য স্কুল ছুটি! কোন পিটুনি নয় কিংবা কোন বকুনি নয়।
কোন দোষ করলে, তার একটাই শাস্তি। “এক সপ্তাহের জন্য স্কুল ছুটি”।।
তাহলে এথেকে নিশ্চয় বোঝাই যায় স্কুলটির প্রতি তার শিক্ষার্থীদের কত্ত মায়া-মমতা, কত্তটা ভালোবাসা, কত্ত টা শেখার আগ্রহ কিংবা এই শেখার আগ্রহ থেকে বঞ্চিত করে সাবধান করতেই হয়তো স্কুল কর্তৃপক্ষেের এরকম অদ্ভুদ শাস্তির বিধান!
স্কুলটিতে রুপকথার জগতের মতো আরো মজার ব্যাপার হলো—
স্কুলটা একটা দেশের মতো!
ছাত্ররা নিজেরাই স্কুল পরিচালনা করে, নিজেরাই নেতৃত্ব তৈরি করে, রেডিও স্টেশন সম্প্রচার করে, নিউজপেপার ছাপায় এমনকি নিজেদের খাবার নিজেরাই চাষ করে উৎপাদন করে। এই স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা নিজেদের উৎপাদিত ফলমূল থেকে নিজেরাই জ্যাম বা জেলি তৈরি করে। আর এরফলে তারা শিখতে পারে বিভিন্ন ফলের পুষ্টিগুণ সম্পর্কে। সেই সাথে কিভাবে এই ফল গুলো দীর্ঘ দিন সংরক্ষন করা যায় তা সম্পর্কে।

নিজেরাই আবার নিজেদের উৎপাদিত ফলমুল এবং শাক-সবজি স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে। আবার এই কাজগুলো থেকে তারা মার্কেটিং ও ইকোনোমিক্স শিখতে পারে।
একই সাথে তারা অর্থ উপার্জন করে । বছরের শেষে, এই টাকা দিয়ে স্কুলের সবাই মিলে বিভিন্ন স্থানে ঘুরতেও যায় । আবার এর মাধ্যমে তারা ভূগোল সম্পর্কে ও শিখতে পারে।
এযেনো রবি ঠাকুরের সেই গানের মতো—
“ আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে,
নইলে মোদের রাজার সনে মিলবো কি স্বত্তে?”..
একদম তাই এই স্কুলে জানি সবাই রাজা।
আর এইভাবে হাতে কলমে শিক্ষার মাধ্যমে স্কুলটির শিক্ষার্থীরা অর্থনীতি, ভূগোল, জীববিজ্ঞান শিখতে পারে।
আর শিক্ষা নিয়ে রেভুল্যুশন করে সফল হওয়া এই সোনাম ওয়াচুকের স্বপ্ন একটি ইউনিভার্সিটি তৈরি করার। আর সেই ভার্সিটির নাম হবে “Doers University”।।
আর university টি তে কাজ করা হবে, আবিষ্কার হবে, কিন্তু কোনো পড়ালেখা হবে না। আর এ থেকেই শিক্ষার্থীরা বাস্তবিক জ্ঞান অর্জন করতে পারবে।।
এবার আসুন সোনম ওয়াংচুকের প্রতিষ্ঠিত এই বিদ্যালয়টি সম্পর্কে একটি মজার এবং গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আপনাদের জানিয়ে রাখি।
এখানে ভর্তির জন্য আপনাকে মেট্রিকে ফেল হতে হবে। পাশ করা জ্ঞানীদের এই স্কুলে ঠাইঁ নেই। আর পাস করেও যদি আপনি আবেদন করেন, তবে থাকবেন ওয়েটিং লিস্টে।
বিদ্যালয়ের কক্ষগুলো মাটি দিয়ে তৈরি। আবার এই কক্ষগুলিও নাকি স্কুলটির শিক্ষার্থীরাই তৈরি করে। নিজেরাই এগুলোর ডিজাইন করে আবার নিজেরাই তা তৈরি করে।

লাদাখের যে এলাকায় বিদ্যালয়টি অবস্থিত, সেখানে বিদ্যুৎ বা গ্যাসের কোন ব্যবস্থাই নেই। তাই এ স্কুলটি সম্পূর্ণভাবে সৌরশক্তিতে নির্ভরশীল।
প্রযুক্তির কলাকৌশলে স্কুল টি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যে, যখন লাদাখে তাপমাত্রা মাইনাস ১৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট থেকে মাইনাস ২০ ডিগ্রি তে থাকে, তখন কিন্তু ভেতরে প্লাস ১৫-২০ ডিগ্রিতে থাকে সে স্কুলটির ক্যাম্পাস।
২০১৬ সালে ফ্রান্সে অনুষ্ঠিত আর্থ আর্কিটেকচার সম্মেলনে স্কুলটির সেরা স্থাপত্যের জন্য আন্তর্জাতিক টেরা অ্যাওয়ার্ড জিতে নিয়েছে এই সেকমল (SECMOL) স্কুল।
স্কুলটি নিয়ে আরো কিছু মজার কথা হচ্ছে—
লাদাখের শিক্ষামন্ত্রী সেওয়াং রিগজিং, দেশ-বিদেশে পুরস্কারপ্রাপ্ত চলচ্চিত্রনির্মাতা স্ট্যানজিন দারজাই ও অল উইমেন্স ট্রাভেল কোর প্রতিষ্ঠাতা ও ভারতে নারীদের সর্বোচ্চ বেসামরিক ‘নারী শক্তি’ পুরস্কারপ্রাপ্ত থিনল্যাস কোরোল এই SECMOL স্কুলের ই শিক্ষার্থী। এরা ৩-৫ বার করে মেট্রিক ফেল করেছিলেন। আর তারপর তারা এই স্কুলের শিক্ষার্থী হিসেবে ভর্তি হয়ে শিখতে পেরেছিলেন জীবন সম্পর্কে বাস্তবিক সব জ্ঞান-বিজ্ঞান সম্পর্কে।
আর তিন থেকে চারবার ফেল করা এই স্কুলটির শিক্ষার্থীরা কেউবা আজ বিশ্বসেরা সাংবাদিক, কেউবা আবার বিশ্বের নামি দামি উদ্যাক্তা কিংবা আরো অনেক ভালো ভালো সব সাফল্যের চূড়ায় অবস্থান করছেন।
মোদ্দা কথা হচ্ছে, বাস্তব জীবনে শিখতে হবে বাস্তব ভাবেই। আর আমরা সব্বাই ই জানি ফেল করা বা অকৃতকার্য হওয়া মানেই জীবনে সব আশা ভরসা সব শেষ নয়। বরং বলা হয়ে থাকে, Failure is the piller of success…
ব্যর্থতা থেকেই নাকি জীবনে সাফল্য আসে। তাই এদের জীবনেও সেই ব্যর্থতা থেকেই সাফল্য এসেছে।
পরিশেষে বলবো, এটা একটা স্বপ্নের স্কুল কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়। আর আমি যদি এতে পড়ার সুযোগ পেতাম তবে চারবার পাচঁবার কেনো প্রয়োজনে হাজারবার ফেইল করতাম। কিন্তু দিনশেষে কিছু অন্তত বাস্তবিক জীবনাচরণ তো শিখতে পারতাম।
আর এরকম চিন্তা ধারার স্কুল টি প্রতিষ্ঠার জন্য স্কুলটির প্রতিষ্ঠাতা সোনাম ওয়াচুক এর জন্য আমাদের চ্যানেল আগামী পরিবারের পক্ষ থেকে রইল অনেক অনেক শুভ কামনা।
স্যার, আপনার এই স্কুলটি আরো অনেক অনেক দূর এগিয়ে যাক। স্কুলের শিক্ষার্থীরা আপনার এবং আপনার এই স্কুলের মুখ উজ্জ্বল করুক এটাই প্রত্যাশা।
এরকম ই কিছু ব্যাতিক্রমী স্বাপ্নিক স্কুল গড়ে উঠুক। আর আমাদের সমাজের কচিকাঁচারা মুক্তি পাক সব মুখস্থ বিদ্যা আর ব্যাগ ভর্তি বইয়ের বোঝা থেকে।
“তারা উড়ে বেড়াক মুক্ত ভাবে,
ঐ দূর আকাশের নীল সীমানায়
আলোকিত করুক,
আর তারা অর্জন করুক,
বাস্তবসন্মত জীবন গড়ার চেতনায়”।।
আর এই হলো সেই “University of Failures” কিংবা ফেইলের বিশ্ববিদ্যালয়ের গল্প।।