Tuesday, November 18, 2025
30 C
Dhaka

মাতা মেরীর প্রাঙ্গণঃ নটরডেম কলেজ

মৈনাক কুমারঃ-

জীবনের শ্রেষ্ঠ কিছু মূহুর্ত কাটিয়েছি নটরডেম কলেজে। ঢাকার প্রাণকেন্দ্র মতিঝিলের যান্ত্রিক জীবন ফেলে এ যেনো এক নতুন প্রাণোচ্ছল নৈসর্গিক ভূবন। আমার স্কুল জীবন কেটেছে আইডিয়াল স্কুল এন্ড কলেজে, তার পাশেই নটরডেমের ক্যাম্পাস।নটরডেম কলেজের আশেপাশে দিয়ে অনেক যাওয়া-আসা হয়েছে,বাবা-মা বলতেন এখানে বাংলাদেশের সেরা শিক্ষার পরিবেশ রয়েছে,তখন থেকেই এখানে পড়ার সুপ্ত বাসনা তৈরী হয়েছে। প্রথমবারের মতো নটরডেম প্রাঙ্গণে ঢোকার সুযোগ পাই ক্লাস এইটে পড়ার সময়।সেবার নটরডেম কলেজের কোনো এক ফেস্টে পার্টিসিপেন্ট হিসেবে অংশ নিয়েছিলাম। গেট দিয়ে প্রবেশ করেই দেখা গেল একটা ম্যুরাল চিত্রকর্ম, একজন মা তার শিশুকে অক্ষরজ্ঞান দিচ্ছে।

তারপর আস্তে আস্তে পুরো নটরডেম প্রাঙ্গণ ঘুরতে ঘুরতে অভিভূত হওয়ার মাত্রা ক্রমেই বাড়তে লাগল।প্রায় শতবর্ষী হ্যারিংটন ভবন তার সাথে লাগোয়া আর্চবিশপ গাঙ্গুলী ভবন,নির্মাণাধীন ফাদার টিম ভবন,মার্টিন হল,নাইট স্কুল,ফাদার ম্যাথিউস ভবন সবকিছুতেই কেমন যেনো এক ঐতিহ্য এর ছোয়া লেগে রয়েছে। তারপর হাটতে হাটতে গেলাম মাঠে,সতেজ ঘাস আর এতো স্বাচ্ছন্দ্যময় গাছা-গাছালি দেখে সকল ক্লান্তি নিমেষেই দূর হয়ে গেলো। এই ক্যাম্পাস ঘুরেই মনের সেই সুপ্ত বাসনা তীব্র বাসনায় পরিণত হয়।মন প্রাণ দিয়ে চেয়েছিলাম যাতে আমি এই কলেজে পড়ার সুযোগ পাই,সৃস্টিকর্তা আমাকে নিরাশ করেননি ২০১৭ সালে নটরডেম কলেজের ব্যবসায় শিক্ষা শাখায় ভর্তি হই। তারপর ক্লাস শুরু,নটরডেমের কলেজের যেই জিনিসটা সবচেয়ে চমকপ্রদ, তা হলো তাদের সময়ানুবর্তিতা প্রতিদিন সকাল ৮ টায় ক্লাস শুরু হতো, কখনোই তা ৮ টা ১ মিনিট বা ৮ টা ২ মিনিট হবে না।

কলেজে পেলাম ভাতৃসম কিছু বন্ধু। এমন ভাবে দিন গুলো আস্তে আস্তে কাটতে লাগলো,এর মধ্যেই আবার মতিঝিল এর বিখ্যাত জলাবদ্ধতার অববাহিকায় নটরডেম ভেসে যাওয়ার অভিজ্ঞতাও করা হয়েছে শুরুর দিনগুলোতেই।তারপর শুরু হলো কুইজ,আপনারা হয়তো অনেকেই এই কুইজ এর সাথে পরিচিত না,এই জিনিসটাই প্রতিটা নটরডেমিয়ান কে দৌড় এর উপরে রাখে। কুইজ জিনিসটা হলো একটা ছোটো খাটো টিউটেরিয়াল এক্সাম(২০/২৫ মার্ক এর এক্সাম কে ১০০ তে রুপান্তর করা হয়) এমন কুইজ এর সম্মুখীন প্রত্যেক নটরডেমিয়ান কে হতে হয় জন্মালে যেমন মরিতে হয়,তেমনি নটরডেমে ভর্তি হলে কুইজ দিতেই হয়।

মুষলধারে বৃষ্টি, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন কিছুই এই কুইজকে থামাতে পারে নাই।এই কুইজ জিনিস টাই অন্য প্রতিষ্ঠান থেকে নটরডেমকে আলাদা করে।অভিশাপ মনে করা এই কুইজ গুলোই যে নটরডেমিয়ানদের প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় কতোটা আত্মবিশ্বাসী করে তা বলে বোখানো যাবে না। এমন কুইজ দিতে দিতে ফুড়ুৎ করে কলেজের একাডেমিক কার্যক্রম শেষ,এবার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রবেশপত্র দেবার পালা। এবার অপেক্ষা করছে,আরেক চমক।নটরডেম কলেজ কতৃপক্ষ ৮৫% উপস্থিতির নিচে কোনো ছাত্রকে প্রবেশপত্র দেয় না,তাকে যতোটুকু ঘাটতি রয়েছে তার জন্য সশ্রম মেকাপ করে প্রবেশপত্র নিতে হয়।

অনেক অপদার্থ এমন নৈসর্গিক ক্যাম্পাসে থাকতেও ক্লাস বাংক দিয়ে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াত তাদেরই এটেন্ডেন্স এ ঘাটতি থাকার জন্য মেকাপ করতে হতো, বলা বাহুল্য আমিও এদের দলের একজন। আমার টেস্ট এর রেজাল্ট ভালো হওয়া সত্বেও এটেন্ডেন্স শর্ট থাকার কারণে আমার অভিভাবক তলব করা হলো।বাবা মারাত্মক কড়া,তাকে নেয়া যাবে না,এসব শুনলে তিনি আমাকে ওখানেই ঠ্যাঙানো শুরু করবেন। তাই হালকা মডারেট মা কে নিয়ে গেলাম।সেখানে গিয়ে শুনলাম আমার এটেন্ডেন্স ৬০%,অর্থাৎ ২৫% শর্ট।এখন আমাকে মেকাপ করতে হবে।

মেকাপের ধাপ দুটি: প্রথমত, প্রতি পার্সেন্টের জন্য দু ঘন্টা কাজ করতে হবে(অর্থাৎ আমার কাজ করতে হবে ২৫×২=৫০ ঘন্টা)। দ্বিতীয়ত, প্রতি পার্সেন্টের কারণে ১০০ টাকা করে জরিমানা(অর্থাৎ আমার জরিমানা ২৫০০ টাকা)। এই ধাপ গুলো পার করলেই আমি ক্লিয়ারেন্স পেপার পেয়ে প্রবেশপত্র পাবো,শুরু হলো আমার সশ্রম সাজা। আমরা ৫০-৬০ জন কালপ্রিট মিলে শুরু করলাম কাজ আমাদের কাজ ছিলো নটরডেমের ক্যাম্পাস পুরোটা ধোয়ানো,ঝরা পাতা টোকানো,কাকের মল পরিষ্কার করা,ক্যাম্পাস ঝাড়ু দেয়া ইত্যাদি।এই সব কাজে সাজার চাইতে মজা বেশী ছিলো। বন্ধুবান্ধব মিলে এইসব করার সময় যে কতো মজা করেছি, তা মনে করলে নস্টালজিক হয়ে যাই। সাড়ে ৮ দিন এর কাজ করার পেলাম ক্লিয়ারেন্স, এই জিনিসটা আমাকে শ্রমের মূল্য শিখিয়েছে, বেড়েছে এই ধরনের কাজ করা মানুষ দের প্রতি সম্মানবোধ।তারপর কলেজে ছাড়ার সময় হয়ে গেলো,দৈর্ঘ্যের দিক থেকে স্বল্প হলেও এই তাৎপর্যপূর্ণ অধ্যায়ের ইতি ঘটল।এখনো সময় পেলেই ছুটে যাই নটরডেমের প্রাঙ্গণে। ইচ্ছে করে সেই ক্লাস গুলোয় বসে ক্লাস করতে, কিন্তু কে দিবে আমায় সে সুযোগ। শেষে একটি কথা বলেই মনকে বুঝ দেই, তা হলো: Once a Notredamian, Always a Notredamian

spot_img

আরও পড়ুন

ভোটের আগে আনসারদের জন্য ১৭ হাজার শটগান কেনা হবে: অর্থ উপদেষ্টা

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা...

নিরাপত্তা পরিষদে গাজা পুনর্গঠনে ট্রাম্পের ২০ দফা পরিকল্পনা অনুমোদিত

জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবিত একটি রেজোলিউশন অনুমোদন করেছে,...

লি‌বিয়া থেকে দেশে ফিরলেন আরও ১৭০ বাংলাদেশি

আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম)-এর সহযোগিতায় লিবিয়ার বেনগাজী শহরের গানফুদা...

দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ দামে স্বর্ণ ও রৌপ্যের স্মারক মুদ্রা

দেশে স্বর্ণের বাজারে নতুন রেকর্ড তৈরি হয়েছে। ইতিহাসে সর্বোচ্চ...

‘দেড় বছরে অন্তর্বর্তী সরকারের মতো এত সাফল্য আর কেউ অর্জন করতে পারেনি’

গত দেড় বছরে অন্তর্বর্তী সরকার যে সাফল্য অর্জন করেছে,...

যে কারণে হাসিনা-কামালের মৃত্যুদণ্ডের রায়ের কপি আজ যাচ্ছে না দুই মন্ত্রণালয়ে

চব্বিশের জুলাই গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত সাবেক...

সংসদ নির্বাচনের জন্য চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ আজ

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আজ মঙ্গলবার (১৮...

ওমরাহ পালন করতে গিয়ে মারা গেলে যে মর্যাদা

ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত ওমরাহ পালন করা। শরিয়তের ভাষায়...

সাবেক মন্ত্রী নানক ও পরিবারের ৫৭টি ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ

পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক মন্ত্রী ও কার্যক্রম নিষিদ্ধ...

ভারতের কিছু খাদ্যপণ্যের শুল্ক প্রত্যাহার করলেন ট্রাম্প

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারতের কয়েকটি মশলা, চা, আম...

চট্টগ্রাম বন্দরে রাশিয়ার যুদ্ধজাহাজ

পাঁচ দিনের সৌজন্য সফরে বাংলাদেশে এসেছে রাশিয়ার নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ...

২১ নভেম্বর উপলক্ষে আইএসপিআরের বার্তা

সশস্ত্র বাহিনী দিবস (২১ নভেম্বর) উপলক্ষে শুক্রবার রাজধানীর ঢাকা...

বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার, স্বপদে ফিরলেন বিএনপির ২৯ নেতা

দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ এবং দলের নীতি ও আদর্শবিরোধী কর্মকাণ্ডের...

পাশের দেশ অশান্তির উসকানি দিচ্ছে : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নষ্ট করার চেষ্টা চালাচ্ছে...
spot_img

আরও পড়ুন

ভোটের আগে আনসারদের জন্য ১৭ হাজার শটগান কেনা হবে: অর্থ উপদেষ্টা

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর নিরাপত্তা কার্যক্রম আরও শক্তিশালী করার জন্য ১৭ হাজার শটগান কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। অর্থ...

নিরাপত্তা পরিষদে গাজা পুনর্গঠনে ট্রাম্পের ২০ দফা পরিকল্পনা অনুমোদিত

জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবিত একটি রেজোলিউশন অনুমোদন করেছে, যাতে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের গাজার জন্য প্রস্তাবিত ২০ দফা পরিকল্পনাকে সমর্থন জানানো হয়েছে। প্রস্তাবে আঞ্চলিক...

লি‌বিয়া থেকে দেশে ফিরলেন আরও ১৭০ বাংলাদেশি

আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম)-এর সহযোগিতায় লিবিয়ার বেনগাজী শহরের গানফুদা ডিটেনশন সেন্টার থেকে আরও ১৭০ জন বাংলাদেশি নাগরিক দেশে প্রত্যাবাসিত হয়েছেন। মঙ্গলবার (১৮ নভেম্বর) সকালবেলা...

দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ দামে স্বর্ণ ও রৌপ্যের স্মারক মুদ্রা

দেশে স্বর্ণের বাজারে নতুন রেকর্ড তৈরি হয়েছে। ইতিহাসে সর্বোচ্চ দামে পৌঁছেছে ভালো মানের স্বর্ণ। বর্তমানে ২২ ক্যারেটের প্রতি ভরি সোনা কিনতে গ্রাহকদের গুনতে হচ্ছে...
spot_img