ইভান পাল
বিনোদন ডেস্ক
“ওয়াইজ ম্যান সে
অনলি ফুলস রাস ইন
বাট আই ক্যান্ট হেল্প
ফলিং ইন লাভ উইথ ইউ”
‘কিং অব রক অ্যান্ড রোল’-এর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে শুধুমাত্র গানটির এই লাইনগুলোই যথেষ্ট। বলছি রক অ্যান্ড রোল ইতিহাসের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং সবচেয়ে বেশি বিক্রিত অ্যালবামের মিউজিশিয়ানদের মধ্যে অন্যতম আমেরিকান সিঙ্গার এলভিস প্রেসলি কথা।
এলভিস এরোন প্রেসলি বা এলভিস প্রেসলি। বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে জনপ্রিয় গায়কদের মধ্যে অন্যতম। তিনি তার ডাকনাম এলভিস নামেও বহুল পরিচিত।
পাশ্চাত্য সংগীত জগতের এই খ্যাতিমান শিল্পী ‘কিং অব রক এন্ড রোল ‘ অথবা ‘দ্য কিং’ নামেও অধিক পরিচিতি লাভ করেছিলেন। এলভিস প্রেসলির জন্ম ৮ জানুয়ারী, ১৯৩৫ সালে, আমেরিকার মিসিসিপি রাজ্যের টুপেলো নামক শহরের। তার বাবার নাম ভ্যারন এলভিস এবং মায়ের নাম লাভ প্রিসলি। তিনি যখন জন্মগ্রহণ করেছিলেন তখন তার বাবার বয়স ছিল ১৮ বছর এবং মায়ের বয়স ছিল ২২ বছর। জেসে গ্যারন প্রেসলি নামে তারঁ একজন জমজ ভাই ও ছিল। যিনি প্রেসলির জন্মের মাত্র ৩৮ মিনিট আগে জন্ম নিয়েছিলেন।
শৈশব থেকেই প্রেসলি ছিল গানের ভক্ত। গানের প্রতি ছিল প্রবল আকর্ষণ। কিন্তু কি করবেন তিনি যে গরীব পরিবারে জন্মেছেন। গরিব পরিবারে জন্মগ্রহণ করা প্রেসলির ভাগ্যে মিউজিক ইনস্ট্রুমেন্ট জোটেনি। তার পরও ছেলের সংগীত প্রতিভা দেখে তার বাবা খুবই নিম্নমানের একটি খেলনা গিটার কিনে দেন প্রেসলিকে। শৈশবে সেই খেলনা গিটারই ছিল এলভিস প্রেসলি’র একমাত্র সম্বল। এই গিটার হাতেই ঘুরে বেড়াতেন ছোট্ট প্রেসলি।
কোন একসময় ক্লাসে এলভিসের গান শুনে এলভিসের ই সঙ্গীত শিক্ষক বলেছিলেন, —
‘‘এ ছেলেকে দিয়ে গান হবে না৷”
ভাবা যায়,, এমন মন্তব্য যার সম্পর্কে করা হয়েছিল সেই ই পরবর্তিকালে ওয়েষ্টার্ণ মিউজিকে রাজত্ব করবে। মাত্র ১৩ বছর বয়সে পারিবারিক কারণেই টেনেসি’র মেমফিস শহরে চলে যেতে হয় এলভিস’কে৷
১৯৫৪ সাল, এলভিস প্রেসলি’র বয়স তখন ১৯বছর। আর এ বছরেই এলভিসের জীবনে এক নতুন মোড় আসে। “সান রেকর্ডিংস (Sun Recordings)” নামে একটি সংগীত বিষয়ক প্রতিষ্ঠানে গান গাওয়ার মাধ্যমে তিনি তার পেশাদার সংগীত জীবনের সূচনা করেন। সান রেকর্ডিংস এর মালিক ছিলেন স্যাম ফিলিপস(Sam Philipps) নামক এক ভদ্রলোক। তিনি সংগীতশ্রোতাদের কাছে আফ্রো-আমেরিকান মিউজিকের একটি জনপ্রিয় রূপ ফুটিয়ে তুলতে সফল হন। তিনি রক এন্ড রোল সংগীতের পুরোধা ব্যক্তিত্ব। ।
তারঁ গাওয়া প্রথম একক গান ছিলো “Heartbreak Hotel”। যেটি ১৯৫৬ সালের জানুয়ারীতে মুক্তি পায়। সমালোচকদের মতে এই গানটির মধ্যেই প্রথম রক এন্ড রোলের সফল ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায়। মুক্তির পরপরই গানটি আমেরিকান টপচার্টের শীর্ষে স্থান করে নেয়।
শুধুমাত্র তার Heartbreak hotel গানই না, তারঁ অন্যান্য গান গুলো ও আমেরিকার সেরা গানের তালিকার প্রথম স্থান দখল করে নেয় এবং তিনি সমকালীন গায়কদের মধ্যে সেরা গায়ক হিসেবে বিবেচিত হন। প্রেসলি প্রথমদিকে “কান্ট্রি” পরে “রিদম অ্যান্ড ব্লুস” ইত্যাদি নিয়ে চেষ্টা করলেও, দু-বছর পর অর্থাৎ ১৯৫৬ সালের দিকে একেবারে নতুন মাত্রায় ভিন্ন সুরে পা বাড়ান। ভেসে যান ‘রক এন রোল ‘-এর ছন্দে, তার মূর্ছনায়৷ রক মিউজিক শুরু হয় তারঁ নতুন প্রচেষ্টা। আর ‘লাভ মি টেন্ডার ‘ ছিল রক মিউজিক এ তারই করা অন্যতম শ্রেষ্ট একটি গান। আবার “ লাভ মি টেন্ডার” এটিই তারঁ ই অভিনীত প্রথম চলচ্চিত্র। আর এই চলচ্চিত্রটির টাইটেল গান ই তিনি করেছিলেন।
তিনি কণ্ঠশিল্পীর পাশাপাশি ছিলেন একজন সুদক্ষ চলচ্চিত্র অভিনেতা। আগেই বলেছি, প্রেসলির অভিনীত প্রথম চলচ্চিত্রের নাম “লাভ মি টেন্ডার” (Love me Tender)। বলা চলে এটি ছিল তারঁ অভিনীত সেরা একটি চলচ্চিত্র। ছবিটি ১৯৫৬ সালের নভেম্বরে মুক্তি পায় । তিনি সব মিলিয়ে ৩৩টি মুভিতে অভিনয় করেছিলেন।
এলভিস প্রেসলির নিজস্ব একটি ব্যান্ড দলও ছিল। দলটির নাম ছিল “দ্যা ব্লু মুন বয়েজ” প্রেসলিসহ আরো দুজন ছিলেন তার এই দলে। তারা হলেন- স্কটি মুরে ও বিল ব্ল্যাক। তার গানের শ্রোতাদের মধ্যে নানা বয়সিরা থাকলেও, কিশোর বয়সী ছেলেমেয়েরা ছিল প্রেসলির গানের অন্ধ ভক্ত।
১৯৫৮ সালে বাধ্যতামুলকভাবে সেনাবাহিনীতে নিয়োগপ্রাপ্ত হন প্রেসলি। ১৯৫৮ সালের সেপ্টেম্বরে মার্কিন প্রশিক্ষন ঘাটিঁ ফোর্ট হুড –এ প্রাথমিক প্রশিক্ষণের পর, মার্কিন বাহিনীর হয়ে জার্মানির ফ্রাইবুর্গ শহরে আসেন এলভিস প্রেসলি৷ আর জার্মানির বাড নয়হাইম শহরে ১৯৫৯ সালের ১৩ই সেপ্টেম্বর এলভিসের আলাপ হয় চৌদ্দ বছর বয়সী সঙ্গীতশিল্পী প্রিসিলা বিউলিউ-এর সঙ্গে৷
প্রায় সাত বছর প্রেম পর্বের পর অবশেষে ১৯৬৭ সালের ১ মে তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। আর ১৯৬৮ সালের ১ লা ফেব্রুয়ারী প্রেসলি-ওয়াগনারের সংসারে আগমন ঘটে নতুন অতিথি তাদের একমাত্র কন্যা লিস্যা ম্যারী প্রিসলির।

ঐ সময়টাতেই তিনি রচনা করেন বিখ্যাত সব রোমাঞ্চকর, আবেগ-আপ্লুত প্রেমের গান৷ একরকম বাধ্য হয়েই তিনি ১৯৫৮ থেকে ১৯৬০ সালে মার্কিন সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন৷ এলভিসের সেনাবাহিনীতে থাকালেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান এলভিসের মা৷ শোর্কাত হয়ে পড়েন এলভিস। আর এর ক’দিন পরই সেনাবাহিনী ছেড়ে এলভিস আবারও সংগীত জগতে ফিরে আসেন। আর পরিবেশন করেন কিছু তুমুল জনপ্রিয় গান। যে গান গুলো আজো তাকেঁ ভক্তদের কাছে চিরস্মরণীয় করে রেখেছে। তিনি সেসময় মঞ্চে গাইতে শুরু করেন, তার সে সময়কার গাওয়া গানগুলো বানিজ্যিকভাবে প্রচুর সফলতা পায়। ১৯৬০ সালে যুক্তরাষ্টে ফিরে আসার পর, প্রথমে চলচ্চিত্রে অভিনয়ে মনোনিবেশ করেন এলভিস৷ নির্মান করেন একের পর এক হিট ছবি৷ রিটার্ন টু সেন্ডার, ভিভা লাস ভেগাস, ক্রাইং ইন দ্য চ্যাপেল ছিল তারঁ নির্মিত চলচ্চিত্র গুলোর মধ্যে অন্যতম সেরা চলচ্চিত্র। শিল্পী থেকে ধীরেধীরে রাজা হয়ে ওঠেন এলভিস প্রেসলি ৷ পান তাঁর প্রথম ‘গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ডস‘ ৷ ১৯৬৮ সালে তিনি সাত বছর পর আবার স্টেজে গান গাইতে শুরু করেন । তার এসময়ের করা ট্যুরগুলোও বানিজ্যিকভাবে সফল হয় এবং সাথে সাথে প্রচুর জনপ্রিয়তাও পান।
তবে সবথেকে দু:খের ব্যাপার ছিল, খুব বেশিদিন স্থায়ী হয় নি প্রেসলি-ওয়াগনারের সংসার। মাত্র ৬ বছরের মাথায় ১৯৭৩ সালের অক্টোবর মাসে ডিভোর্স হয়ে যায় তাদের। এসময় সমগ্র আমেরিকায় ছিল এলভিস প্রেসলির চাহিদা। স্টেজ প্রোগ্রাম করার জন্য তাকে বিভিন্ন শহরে ছুটে বেড়াতে হতো। তাই একদিকে বিবাহ বিচ্ছেদ ও অন্যদিকে ছোটাছুটি এবং শরীরের ওজন বেড়ে যাওয়া সব মিলিয়ে জীবনের খেই হারিয়ে ফেলেন প্রেসলি। এই সময়েই হয়তোবা ড্রাগের প্রতি আসক্ত হয়ে পরেন এলভিস প্রেসলি।
১৯৬৫ সালে বিখ্যাত ব্যান্ডদল “ বিটলস” এসেছিল আমেরিকাতে, তারা একজন মাত্র ব্যক্তির সাথে দেখা করতে এসেছিলেন, আর তিনি হলেন — এলভিস প্রেসলী। প্রেসলী এবং বিটলস একসাথে একটি পুরো দিন কাটিয়েছে ক্যালিফোর্ণিয়ায় নিজের বাড়ীতে।
১৯৭৩ সালে এলভিস প্রেসলির স্টেজে করা একটি গান প্রথমবারের মত স্যাটেলাইট থেকে দেখা হয়। স্যাটেলাইটের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী প্রায় দেড় বিলিয়ন দর্শক গানটি সরাসরি উপভোগ করে। বেশীরভাগ সমালোচকই মনে করেন,, তিনি জীবনের শেষদিকে এসেই মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছিলেন।। আর এ মাদকাদ্রব্যকেই তার মৃত্যুর মূল কারণ হিসেবে অভিহিত করা হয়।।
কিছু কিছু মানুষ আছে যাদের অবদান মানুষ কখনোই ভুলতে পারবেন না। এলভিস প্রেসলিও ছিল তেমন ই একটি নাম। মৃত্যুর পরেও তারঁ যে জনপ্রিয়তা তার ছিটেফোটাও কমেনি, কমাতে পারেনি কেউই। এখনো তার বিখ্যাত এলবামগুলোর চাহিদা রয়েছে আগের মতই, আর তার কপিও প্রকাশিত হচ্ছে বছরের পর বছর। প্রতি বছর তার মৃত্যুবার্ষিকীর ঠিক এক সপ্তাহ আগে তার প্রিয় শহর মেমফিসে তাঁর প্রাক্তন স্ত্রী প্রিসিলা ও মেয়ে লিসা প্রেসলির উদ্যোগে আয়োজিত হয় “প্রিসলি উইক”। আর এতে ভীড় জমান প্রেসলির অসংখ্য ভক্ত অনুরাগীরা। মিসিসিপির সেই বাড়িটি যেখানে তিনি জন্মগ্রহন করেছিলেন, সেই বাড়ীটিতে গড়ে তোলা হয়েছে প্রেসলির নামে মিউজিয়াম ও পার্ক।
এলভিস প্রেসলি যেমন ছিলেন একজন খ্যাতিমান শিল্পী, ঠিক তেমনি ছিলেন আবার অন্যরকম এক অদ্ভুদ মানুষ। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়,,
আমেরিকায় প্রায় সবার বাড়ীতেই পোষা প্রাণী আছে। বেশীর ভাগ আমেরিকান পছন্দ করেন কুকুর অথবা বেড়াল। কিন্তু এলভিসের পোষা প্রাণীটি ছিল ‘স্ক্যাটার’ নামে এক শিম্পাঞ্জী।
১৯৭৭ সালের ১৬ ই আগস্ট ৪২ বছর বয়সে পুরো বিশ্বের সংগীত ভক্তদের কাঁদিয়ে পৃথিবী থেকে চিরতরে বিদায় নেন এলভিস প্রেসলি। প্রথমদিকে ধারণা করা হয় অত্যধিক মাত্রায় মাদক সেবনের ফলেই তার মৃত্যু ঘটে। কিন্তু পরবর্তীতে জানা যায় হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়েই তারঁ মৃত্যু ঘটে।