বিএনপির চেয়ারপারসন ও তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবনের এক অনন্য বৈশিষ্ট্য ছিল—তিনি কখনও কোনো সংসদীয় আসনে পরাজিত হননি। ১৯৮১ সালের মে মাসে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ও তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের সময় খালেদা জিয়া ছিলেন একজন সাধারণ গৃহবধূ। রাজনীতির সঙ্গে তাঁর প্রত্যক্ষ সম্পৃক্ততা তখনো শুরু হয়নি। রাজনৈতিক কর্মসূচি কিংবা জনসমাবেশে তাঁর উপস্থিতিও খুব একটা দেখা যেত না।
সময় ও পরিস্থিতির নির্মম বাস্তবতায় সেই গৃহবধূকেই স্বামী হারানোর শোক বুকে নিয়ে দলের হাল ধরতে হয়। নানা ষড়যন্ত্র, প্রতিবন্ধকতা ও প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে তিনি রাজনীতির কঠিন পথ পাড়ি দেন। ঘরে-বাইরে নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে ধীরে ধীরে তিনি পরিণত হন দেশের অন্যতম প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেত্রীতে। রাজনৈতিক সংগ্রামের এই দীর্ঘ যাত্রায় তিনি হয়েছেন তিনবারের প্রধানমন্ত্রী এবং বাংলাদেশের প্রথম নির্বাচিত নারী প্রধানমন্ত্রী।
নির্বাচনী রাজনীতিতে খালেদা জিয়ার সাফল্য ছিল ব্যতিক্রমী। ফেনী, বগুড়া, ঢাকা, চট্টগ্রাম, লক্ষ্মীপুর কিংবা খুলনা—যেখানেই তিনি নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন, সেখানেই বিজয়ী হয়েছেন। দেশের নির্বাচনী ইতিহাসে তিনি একমাত্র নেতা, যিনি পাঁচটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মোট ২৩টি সংসদীয় আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে প্রতিটিতেই জয় লাভ করেন। ভোটে পরাজয়ের কোনো নজির নেই তাঁর রাজনৈতিক জীবনে।
১৯৯০ সালের গণ-অভ্যুত্থানে স্বৈরাচার এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে খালেদা জিয়া বগুড়া–৭, ঢাকা–৫, ঢাকা–৯, ফেনী–১ ও চট্টগ্রাম–৮—এই পাঁচটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। সবকটি আসনেই তিনি বিপুল ভোটে বিজয়ী হন। ওই নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপি সরকার গঠন করলে তিনি বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হন। একই সঙ্গে তিনি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কোনো দেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বিশ্ব রাজনীতিতেও স্থান করে নেন।
১৯৯৬ সালের জুনে অনুষ্ঠিত সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। তবে সেই নির্বাচনেও খালেদা জিয়াকে হারানো সম্ভব হয়নি। তিনি বগুড়া–৬, বগুড়া–৭, ফেনী–১, লক্ষ্মীপুর–২ ও চট্টগ্রাম–১—এই পাঁচটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সবগুলোতেই বিজয়ী হন।
এর আগে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি সরকার গঠন করে। ওই নির্বাচনে খালেদা জিয়া ফেনী–১ ও ২, বগুড়া–৭, সিরাজগঞ্জ–২ ও রাজশাহী–২ আসন থেকে নির্বাচিত হন এবং টানা দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন। তবে একতরফা সেই নির্বাচন নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক সৃষ্টি হয়। ওই সংসদেই নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংক্রান্ত বিল পাস হয়। শপথ নেওয়ার মাত্র ১১ দিনের মাথায় তিনি পদত্যাগ করেন এবং সংসদ ভেঙে দেওয়া হয়।
২০০১ সালের ১ অক্টোবর অনুষ্ঠিত অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে খালেদা জিয়া বগুড়া–৬, বগুড়া–৭, খুলনা–২, ফেনী–১ ও লক্ষ্মীপুর–২—এই পাঁচটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সব কটিতে জয়লাভ করেন। এই নির্বাচনে বিজয়ের মধ্য দিয়ে বিএনপি আবার ক্ষমতায় গেলে তিনি তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন।
২০০৮ সালে নির্বাচন কমিশন একজন প্রার্থীর জন্য সর্বোচ্চ তিনটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ নির্ধারণ করলে খালেদা জিয়া বগুড়া–৬, বগুড়া–৭ ও ফেনী–১ আসন থেকে নির্বাচন করেন। তিনটি আসনেই তিনি বিজয়ী হন।
রাজপথের আন্দোলনেও খালেদা জিয়ার ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। টানা আট বছর তিনি স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। শুরুতে একা পথ চললেও একসময় তিনি পুরো জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হন। কখনও আপস না করায় তিনি ‘আপসহীন নেত্রী’ হিসেবে পরিচিতি পান। দৃঢ় মনোবল, দেশপ্রেম এবং গণতন্ত্রের প্রতি দায়বদ্ধতার কারণেই জনগণের সমর্থন তিনি আজীবন ধরে রাখতে পেরেছেন।
মঙ্গলবার (৩০ ডিসেম্বর) ভোর ৬টায় রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৯ বছর।
শ্বাসকষ্ট বেড়ে যাওয়ায় গত ২৩ নভেম্বর তাঁকে জরুরি ভিত্তিতে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এর আগে ২১ নভেম্বর সশস্ত্র বাহিনী দিবসের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে রওনা হয়ে গাড়িতে ওঠার সময় তিনি অসুস্থতা অনুভব করেন। দীর্ঘদিন ধরে তিনি লিভার সিরোসিস, আর্থ্রাইটিস, ডায়াবেটিস, কিডনি, ফুসফুস ও চোখের সমস্যাসহ নানা জটিলতায় ভুগছিলেন।
সিএ/এএ


