হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের প্রতিষ্ঠিত জাতীয় পার্টি আবারও বিভক্ত। জুলাই অভ্যুত্থানের পর নির্বাচনের আগে আনিসুল ইসলাম মাহমুদের নেতৃত্বে দলের একাংশ ভেঙে নতুন জাতীয় পার্টি গঠিত হয়েছে। অন্যদিকে এরশাদের ভাই জি এম কাদেরের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে জাতীয় পার্টির আরেকটি অংশ। কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকায় আওয়ামী লীগ আসন্ন নির্বাচনে অংশ নিতে পারছে না। তবে তাদের দীর্ঘদিনের সহযোগী জাতীয় পার্টির ভোটে অংশগ্রহণে বাধা নেই। এ অবস্থায় আগামী নির্বাচনে জাতীয় পার্টির দুই অংশের মধ্যে কে কার চেয়ে এগিয়ে থাকবে, তা রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনার কেন্দ্রে এসেছে।
এরশাদ জীবিত থাকতেই একাধিকবার জাতীয় পার্টি বিভক্ত হয়েছে। তবে প্রতিবারই এরশাদের নেতৃত্বাধীন অংশটি মূল জাতীয় পার্টি হিসেবে পরিচিত ছিল। ২০০৮ সালের নির্বাচনে দলটি সংসদের তৃতীয় বৃহত্তম দল হয়। ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর জাতীয় পার্টি সংসদের প্রধান বিরোধী দলের আসনে বসে, যদিও পরে তারা সরকারেও যোগ দেয়। আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত তিনটি বিতর্কিত নির্বাচনে দলটির ভূমিকা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের সহযোগী হিসেবে জাতীয় পার্টিকে নিষিদ্ধ করার দাবি তোলে জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি এবং গণ অধিকার পরিষদ। তবে অন্তর্বর্তী সরকার আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করলেও জাতীয় পার্টির বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। রাজনৈতিক মহলে আলোচনা রয়েছে, জাতীয় পার্টিকে নিষিদ্ধ করার দাবির পেছনে উদ্দেশ্য দলটির ভোট নিজেদের ভাগে নেওয়া। অন্যদিকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ থাকায় জাতীয় পার্টির দুই অংশেরই লক্ষ্য এখন আওয়ামী লীগের ভোট নিজেদের দিকে টানা।
আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব বর্তমানে কারাগারে অথবা পলাতক। দলটির প্রধান শেখ হাসিনা মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ পাওয়ার পর অভ্যুত্থানের মুখে গত বছরের ৫ আগস্ট ভারতে চলে যান এবং এখনো সেখানে অবস্থান করছেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৪৮ শতাংশ এবং ২০০১ সালের নির্বাচনে ৪০ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। বর্তমানে দলটির প্রকৃত ভোটভিত্তি কতটা রয়েছে, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। গত মাসে প্রথম আলোর এক জরিপে দেখা গেছে, ২৮ শতাংশ মানুষ আগামী নির্বাচনে বিনা শর্তে আওয়ামী লীগকে রাখার পক্ষে। এই অংশের বড় একটি অংশকে আওয়ামী লীগের সমর্থক হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
অন্তর্বর্তী সরকার পরিষ্কার করেছে, আওয়ামী লীগ আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না। শেখ হাসিনাকে বাদ দিয়ে পরিশুদ্ধ আওয়ামী লীগকে ভোটে রাখার কিছু চেষ্টা হলেও তা সফল হয়নি। সরকারের ধারণা ছিল, আওয়ামী লীগের তুলনামূলক পরিশীলিত নেতারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন। কিন্তু এ ধরনের কোনো প্রস্তুতি বা আলোচনার খবরও পাওয়া যাচ্ছে না। এই পরিস্থিতিতে বিএনপি, জামায়াতসহ বিভিন্ন দল আওয়ামী লীগের ভোট নিজেদের দিকে টানার চেষ্টা করছে। জাতীয় পার্টির দুই অংশও আওয়ামী লীগের ভোটের দাবিদার হিসেবে সামনে আসায় বাড়তি আলোচনা তৈরি হয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ঐতিহাসিকভাবে জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছে। ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে বিএনপি বর্জন করলেও আওয়ামী লীগ অংশ নেয়। ১৯৯৬ সালে ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফেরে জাতীয় পার্টির সমর্থনে। ২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ছিল জাতীয় পার্টি। ২০০৮ সালের নির্বাচনে সমঝোতার মাধ্যমে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট করে ভোট করে এবং সরকারে যোগ দেয়। এই দীর্ঘ রাজনৈতিক সখ্যের কারণে আওয়ামী লীগের ভোট পাওয়ার প্রত্যাশা জাতীয় পার্টির জন্য অযৌক্তিক নয় বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
নতুন জাপা কি পুরোনোটিকে ছাড়িয়ে যাবে
জাতীয় পার্টির একাংশের চেয়ারম্যান জি এম কাদের ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী ছিলেন। নতুন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ এবং নির্বাহী চেয়ারম্যান মুজিবুল হক চুন্নুও আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারে দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে আনিসুল ইসলাম মাহমুদের সঙ্গে জাতীয় পার্টির অধিকাংশ শীর্ষ নেতা রয়েছেন, যাঁদের অনেকেই সাবেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য।
অতীতে জাতীয় পার্টি ভেঙে গঠিত দলগুলোর অনেক নেতাই নতুন অংশের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। এর মধ্যে আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি (জেপি) অন্যতম। আনোয়ার হোসেন দুই দফা শেখ হাসিনার সরকারের মন্ত্রী ছিলেন। এই জোটের নাম দেওয়া হয়েছে জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট (এনডিএফ)। এতে নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত মিলিয়ে ১৮টি রাজনৈতিক দল রয়েছে। জোটের পক্ষ থেকে ১১৯টি আসনে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে।
এনডিএফের মনোনয়ন তালিকা বিশ্লেষণে দেখা যায়, অন্তত ১৮ জন একাধিকবার সংসদ সদস্য ছিলেন। তাঁদের মধ্যে সাতজন বিভিন্ন সময় মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। এর বিপরীতে জি এম কাদেরের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টিতে বর্তমানে তেমন পরিচিত নেতা নেই বললেই চলে। ফলে রাজনৈতিক আলোচনায় নতুন জাতীয় পার্টি তুলনামূলক বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে।
সরকার ও রাজনৈতিক সূত্রগুলোর মতে, আনিসুল ইসলাম মাহমুদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি বিভিন্নভাবে সরকার ও প্রভাবশালী মহলের ভেতর থেকে সমর্থন পাচ্ছে। কেউ কেউ নতুন দলটিকে জামায়াতের বিকল্প হিসেবে গড়ে তোলার চিন্তাও করছেন। তবে বড় প্রশ্ন হয়ে আছে লাঙ্গল প্রতীক কার থাকবে। এই বিষয়ে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না হলেও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা, লাঙ্গল জি এম কাদেরের অধীনেই থাকার সম্ভাবনা বেশি।
জাতীয় পার্টি শুরু থেকেই নেতানির্ভর দল। বৃহত্তর রংপুরের বাইরে সংগঠন দুর্বল এবং সমর্থকও কমে এসেছে। প্রথম আলোর সাম্প্রতিক জরিপে দেখা গেছে, মাত্র শূন্য দশমিক ১ শতাংশ মানুষ মনে করে আগামী নির্বাচনে জাতীয় পার্টি সরকার গঠন করতে পারে। তবে পুরোনো ও পরিচিত নেতাদের নিয়ে গঠিত আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, রুহুল আমিন হাওলাদার, কাজী ফিরোজ রশীদ ও মুজিবুল হক চুন্নুর নেতৃত্বাধীন এনডিএফ জোট কিছুটা প্রভাব তৈরি করতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
জি এম কাদেরের জাপায় আলোচিত নেতা কম
এরশাদ জীবিত থাকা অবস্থায়ই রওশন এরশাদ ও জি এম কাদেরের মধ্যে নেতৃত্ব নিয়ে বিরোধ ছিল। এরশাদের মৃত্যুর পর সেই সমন্বয় আর নেই। রওশন এরশাদ অসুস্থ হলেও তাঁর নেতৃত্বে জাতীয় পার্টির একটি ধারা রয়েছে। ২০২৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জি এম কাদেরকেই মূল নেতা হিসেবে গুরুত্ব দেয়। কিন্তু এখন আনিসুল ইসলাম মাহমুদের নেতৃত্বে জ্যেষ্ঠ নেতারা জি এম কাদেরকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছেন।
বর্তমানে জি এম কাদেরের দলের মহাসচিব হয়েছেন অপেক্ষাকৃত তরুণ শামীম হায়দার পাটোয়ারি। এর বাইরে দলে পরিচিত নেতার সংখ্যা কম। সাবেক মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গাকে গত বছর সেপ্টেম্বরে দল থেকে বহিষ্কার করা হলেও ১৪ ডিসেম্বর তিনি ক্ষমা চেয়ে আবার দলে ফেরেন। একই সঙ্গে রংপুর-৬ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য নূর মোহাম্মদ মণ্ডলও পুনরায় দলে যোগ দিয়েছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, রংপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা ও নীলফামারীসহ উত্তরাঞ্চলে এরশাদের জাতীয় পার্টির প্রতি এখনো কিছুটা সহানুভূতি রয়েছে। এরশাদের ভাইয়ের নেতৃত্বে জি এম কাদেরের পক্ষেই সেই সমর্থন যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। লাঙ্গল প্রতীক ও এরশাদের প্রতি দুর্বলতার কারণে বৃহত্তর রংপুরে দলটি কিছুটা অবস্থান ধরে রাখতে পারে, তবে সারা দেশে বড় প্রভাব ফেলতে পারবে না।
জুলাই অভ্যুত্থানের পর কাকরাইলে জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে একাধিক দফা ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এরপরও আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনে প্রার্থী দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে জি এম কাদেরের জাতীয় পার্টি। মনোনয়ন ফরম বিক্রি শুরু হলেও আগের তুলনায় আগ্রহ কম দেখা যাচ্ছে। এ অবস্থায় দলটি সারা দেশে কতটা যোগ্য প্রার্থী দিতে পারবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
অতীত ভূমিকার কারণে অন্তর্বর্তী সরকারের ১৬ মাসে জি এম কাদেরের জাতীয় পার্টি উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করতে পারেনি। সরকার ও নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বিভিন্ন দলের সংলাপে জি এম কাদের আমন্ত্রণ পাননি। সে তুলনায় আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর নেতৃত্বাধীন জোটকে কর্মসূচি পালনে তেমন বাধার মুখে পড়তে হচ্ছে না। ফলে নতুন জোট পুরোনো জাতীয় পার্টির জায়গা নিতে যাচ্ছে কি না, তা নিয়ে আলোচনা আরও জোরালো হয়েছে।
আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, আওয়ামী লীগের ভোট যে অংশ টানতে পারবে, নির্বাচনী দৌড়ে তারাই এগিয়ে থাকবে।
সিএ/এএ


