নরসিংদীর মাধবদীতে শুক্রবার যে ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয়েছে, তা মুহূর্তেই কাঁপিয়ে তোলে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বৃহৎ অংশকে। ৫ দশমিক ৭ মাত্রার এই ভূকম্পনে এখন পর্যন্ত অন্তত ১০ জন নিহত এবং পাঁচ শতাধিক মানুষ আহত হওয়ার ঘটনা জানা গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূগর্ভে জমে থাকা শক্তি হঠাৎ মুক্ত হওয়ার কারণেই এই কম্পন ঘটে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞদের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা থেকে মাত্র ৩০ কিলোমিটার দূরে মাটির প্রায় ১০ কিলোমিটার গভীরে শক্তি জমতে থাকায় কম্পন সৃষ্টি হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ইউএসজিএস জানিয়েছে, প্রায় সাত কোটি মানুষ ঝাঁকুনি অনুভব করেছেন। আবহাওয়া বিভাগও এই ভূমিকম্পকে সাম্প্রতিক বছরের সবচেয়ে ভয়াবহ হিসেবে উল্লেখ করেছে।
এর পরদিন শনিবার একই এলাকায় আরও দুবার ভূমিকম্প হয়— যার মাত্রা ছিল ৩ দশমিক ৩ ও ৪ দশমিক ৩। উভয়ের উৎপত্তিস্থল ছিল নরসিংদীর পলাশ উপজেলা। ফলে প্রশ্ন উঠেছে— কেন এই অঞ্চল হঠাৎ বড় ভূমিকম্পের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠল?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ সৈয়দ হুমায়ুন আখতারের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, ইন্ডিয়ান প্লেট ও বার্মিজ প্লেটের গতিসীমার পরিবর্তনেই এ বিপর্যয়। তিনি জানান, পৃথিবীর ভূ-পৃষ্ঠ টেকটোনিক প্লেটে বিভক্ত এবং এই প্লেটগুলোর সংঘর্ষ বা সরে যাওয়ার মধ্যেই শক্তি সঞ্চয় হয়। সেই শক্তি শিলাস্তরের ধারণক্ষমতার সীমা ছাড়িয়ে গেলে ভূমিকম্প সৃষ্টি হয়।
ইতিহাস বলছে ভয়ংকর সম্ভাবনার কথা
ইউএসজিএসের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৫০ সালের পর থেকে একই অঞ্চলে ৫ দশমিক ৫ বা তার বেশি মাত্রার ১৪টি ভূমিকম্প রেকর্ড করা হয়েছে। বাংলাদেশের ভূমিকম্পের প্রধান দুটি উৎস— ডাউকি ফল্ট এবং সিলেট-চট্টগ্রাম-টেকনাফ পর্যন্ত বিস্তৃত দীর্ঘ ফল্ট জোন। ভূতাত্ত্বিক পরিস্থিতির কারণে পশ্চিমে ইন্ডিয়ান প্লেট, পূর্বে বার্মা প্লেট ও উত্তরে ইউরেশিয়ান প্লেটের চাপে বাংলাদেশ অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে।
ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ হুমায়ুন আখতার বলেন, ভারতীয় প্লেট ধীরে ধীরে পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে বার্মা প্লেটের নিচে ঢুকে যাচ্ছে। ফলে একটি ভয়ংকর সাবডাকশন জোন তৈরি হয়েছে, যার ব্যাপ্তি সিলেট থেকে টেকনাফ পর্যন্ত। এই জোনের বিভিন্ন সেগমেন্টে ৮ দশমিক ২ থেকে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প ঘটানোর মতো শক্তি জমা আছে এবং তা বের হবেই।
তিনি জানান, নরসিংদীতে দুই প্লেটের সংযোগস্থলে লকড অবস্থা ছিল। তার সামান্য অংশ নড়ে যাওয়াতেই শুক্রবারের ভূমিকম্প হয়েছে। এটি বড় বিপদের আগমনী বার্তা। কারণ কিছু শক্তি বের হয়ে যাওয়ায় সামনে বড় ভূমিকম্প ঘটার পথ আরও সহজ হয়েছে।
৮০০ বছর ধরে শক্তির সঞ্চয়
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সংযোগস্থলে প্রায় ৮০০ বছর ধরে শক্তি জমা হচ্ছে। এর প্রভাব পড়লে ঢাকায় ব্যাপক প্রাণহানি ও বড় ধরনের বিপর্যয়ের ঝুঁকি রয়েছে। বিশেষত অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সংখ্যার কারণে রাজধানী হয়ে উঠতে পারে মৃত্যুপুরী।
ইতিহাসে বড় বড় ভূমিকম্পে নদীর গতিপথ বদলে যাওয়ার নজির আছে। ১৭৯৭ সালের কম্পনে ব্রহ্মপুত্র নদীর পথ পাল্টে পশ্চিমে চলে যায়। ১৭৬২ সালের টেকনাফ-মিয়ানমার ভূমিকম্পে সেন্টমার্টিন দ্বীপ প্রায় তিন মিটার উঁচু হয়ে যায়। সিলেট, মৌলভীবাজার ও কিশোরগঞ্জ অঞ্চলে ১৯২২ সালে ৭ দশমিক ৬ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল। এছাড়া ১৮৬৮ সালে একই এলাকায় ৭ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্প রেকর্ড করা হয়।
১৮৯৭ সালে ডাউকি ফল্টে ঘটে ৮ দশমিক ৭ মাত্রার আরেক শক্তিশালী ভূমিকম্প। এর যেকোনো একটি উৎস এলাকা থেকে বড় কম্পন হলে ঢাকায় ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটতে পারে বলে বারবার সতর্ক করে আসছেন বিশেষজ্ঞরা।
সূত্র: বিবিসি বাংলা
সিএ/এমআরএফ


