২০২৫ সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে এসে বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি চট্টগ্রাম বন্দর দাঁড়িয়ে আছে এক গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক মোড়ে। বৈশ্বিক লজিস্টিকস ইনডেক্সে অবস্থান শক্তিশালী করা এবং ক্রমবর্ধমান আমদানি-রপ্তানির চাপ সামাল দিতে বন্দরের আধুনিকায়ন এখন আর বিলাসিতা নয়, বরং সময়ের কঠিন বাস্তবতা। এই প্রেক্ষাপটে চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে উঠেছে দেশের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও ভবিষ্যৎ প্রবৃদ্ধির কেন্দ্রবিন্দু।
দীর্ঘদিনের কাঠামোগত স্থবিরতা ও সনাতন ব্যবস্থার কারণে বন্দরের সক্ষমতা প্রশ্নের মুখে পড়েছিল। আধুনিক প্রযুক্তি ও দক্ষ ব্যবস্থাপনার অভাবে প্রতিযোগিতামূলক বিশ্ববাণিজ্যে টিকে থাকা ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠছিল। এই বাস্তবতায় বন্দর আধুনিকায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে আরও গভীর একটি প্রশ্ন—এই অগ্রযাত্রা কি জাতীয় সার্বভৌমত্বের সীমারেখা অতিক্রম করছে?
সার্বভৌমত্ব শুধু ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ নয়, বরং রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সম্পদের ওপর পূর্ণ কর্তৃত্ব ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা। এই জায়গা থেকেই চট্টগ্রাম বন্দরের লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল নিয়ে ডেনমার্কভিত্তিক এপিএম টার্মিনালসের সঙ্গে স্বাক্ষরিত ৩০ বছরের চুক্তিটি নতুন করে আলোচনায় এসেছে। আধুনিকায়নের এই উদ্যোগ একদিকে যেমন আন্তর্জাতিক মানের প্রযুক্তি ও ব্যবস্থাপনার সুযোগ তৈরি করছে, অন্যদিকে তেমনি জাতীয় নিয়ন্ত্রণ ও মালিকানা নিয়ে উদ্বেগও তৈরি করেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বিদেশি বিনিয়োগ প্রয়োজন, তবে তা এমনভাবে হতে হবে যাতে কৌশলগত নিয়ন্ত্রণ দেশের হাতেই থাকে। জাতীয় সম্পদকে দীর্ঘমেয়াদি ইজারায় দেওয়ার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা, আর্থিক ন্যায্যতা ও রাষ্ট্রীয় স্বার্থের সুরক্ষা নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আধুনিকায়নের নামে কোনোভাবেই যেন জাতীয় সম্পদ নামমাত্র মূল্যে বা সিদ্ধান্তের বাইরে চলে না যায়—এই প্রশ্ন এখন সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত।
বর্তমান বৈশ্বিক রাজনীতিতে বঙ্গোপসাগর একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত অঞ্চল। এই অঞ্চলে অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করা বাংলাদেশের জন্য অপরিহার্য। চট্টগ্রাম বন্দর কেবল একটি বাণিজ্যিক অবকাঠামো নয়, এটি দেশের সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা ও কৌশলগত অবস্থানের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত।
দীর্ঘদিনের স্থবিরতা কাটিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর যখন নতুন যুগে প্রবেশের দ্বারপ্রান্তে, তখন স্পষ্টভাবে মনে রাখতে হবে—আধুনিকায়ন প্রয়োজন, তবে তা আত্মমর্যাদা ও জাতীয় মালিকানা বিসর্জন দিয়ে নয়। অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও সার্বভৌমত্বের ভারসাম্য রক্ষা করাই এখন সময়ের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
সিএ/এএ


