Sunday, April 27, 2025
28 C
Dhaka

সিতারা কথন

মাহমুদ আব্দুল্লাহ

সিতারা নামের সৌম্যদর্শন বালকটির জন্ম অধুনা কাছাড়ের করিমগঞ্জে। গায়ের রং উজ্জ্বল গৌর বর্ণের হওয়ায় নাম পড়ল সিতারা। কালে কালে যে সে হয়ে উঠবে বাংলাসাহিত্যের উজ্জ্বল সিতারা সেটা তখন কেই বা জানত। বলছিলাম প্রাতঃস্মরণীয় সৈয়দ মুজতবা আলীর কথা। রসগোল্লা বইপড়া প্রবন্ধের জনক, শবনমের সৃষ্টা, পঞ্চতন্ত্রের কথক। আমাদের রায়পিথৌরা এই লেখক কিন্তু প্রথম জীবন থেকেই লেখালেখি শুরু করেননি। বরং গুরু রবীন্দ্রনাথ অনুমতি দেবার পরও সর্ব প্রথম বই লিখেছেন চুয়াল্লিশ বছর বয়সে।

সিলেটের খানবাহাদুর সৈয়দ সিকান্দর আলীর কনিষ্ঠ পুত্র আলী সাহেব পড়াশোনা শুরু করেছিলেন সুনামগঞ্জে। মৌলভীবাজার ও সিলেটে পড়াকালীন সময়ে ১৯২১ সালে যখন দেশব্যাপী অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়েছিল তখন সেই তাপে উদ্বেলিত হয়েছিলেন লেখক নিজেও। নিজ লেখায় অবশ্য সেটাকে উল্লেখ করেছেন স্কুলফাঁকি দেবার উসিলা হিসেবে। কিন্তু যখন জানতে পারি স্কুলজীবনেই মুজতবা রুবাইয়াতে ওমর খৈয়াম পড়ছেন একাধারে কান্তি ঘোষ সত্যেন দত্ত আর ফিটজেরাল্ডের অনুবাদে, তখন আমাদের বুঝতে বাকি থাকেনা স্কুলফাঁকি দেবার বান্দা তিনি অন্তত নন।

সিলেট শহরে একবার রবীন্দ্রনাথ এসেছিলেন। ছেলেবেলায় ইংরেজ পরিদর্শকের ঘড়ি দেখতে চাওয়া সাহসী মুজতবা বাড়ির কাউকে না জানিয়ে চিঠি লিখলেন রবীন্দ্রনাথের কাছে ‘আকাংখা উচ্চ করিতে কী করা প্রয়োজন?’ দিনকয়েকবাদে আসমানি রংয়ের কাগজে আগরতলা থেকে ফিরতি চিঠি এল স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের পক্ষ থেকে। চিঠির জবাব দেওয়ার জন্য প্রবাদপ্রতিম কবিগুরুর পত্র একদিকে যেমন সৈয়দ পরিবারে আলোড়ন তুলল, অন্যদিকে পরবর্তী জীবনে মজলিসি গদ্যের রাজপুত্র কোন নদী ধরে বইবেন সেটিও নির্দিষ্ট করে দিল। বিশ্বভারতীর একেবারে প্রথমদিককার ছাত্র হিসেবে মুজতবা চললেন বিদেশ বিভূঁইয়ে বিদ্যার্জনের জন্য। এই যে নিজ দেশ থেকে বেরিয়ে এলেন, আর কখনো তিনি সিলেটে স্থায়ীভাবে ফিরে আসার সুযোগ পাননি।

বিশ্বভারতীতে তখন রবীন্দ্রনাথ সারাবিশ্বের অধ্যাপকদের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন, নিজেও অধ্যাপনা করছেন। তার কাছে পড়লেন স্বদেশ ও বিদেশের সাহিত্য, এমনকি বিশ্বভারতী প্রথম স্নাতক ছিলেন সৈয়দ মুজতবা আলী। তারপর আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়, বার্লিন ও বন্ বিশ্ববিদ্যালয়, লন্ডন ও প্যারিস এবং শেষে জামিয়া আল আজহারে পড়লেন। নানান দেশ, নানা শাস্ত্র, বহুভাষা আর বিপুল অভিজ্ঞতার সঞ্চয় নিয়ে সৈয়দ মুজতবা আলী স্বদেশে ফিরলেন ১৯৩৮ শে। ততদিনে পি.এইচ.ডি. করেছেন, পনেরোটি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেছেন। বাবাকে উৎসর্গ করা থিসিস জার্মানি থেকে বেরিয়েছে ‘The origin of the Khozhas and their religious life to-day’ এই শিরোনামে। বাবা পুত্রের সাহিত্যকীর্তি না দেখে যেতে পারলেও এই থিসিসটি প্রকাশিত হওয়ায় আনন্দিত হয়েছিলেন। এমনকি সর্বদা সঙ্গে রাখতেন বলেও আমরা জানতে পারি তার বড়ভাইয়ের লেখায়।

একবার এয়ারপোর্টে বিদেশ যাত্রার সময় মুজতবা আলী পেশার ঘরে লিখেছিলেন ‘চাকরি ছাড়া’। তখন অফিসার অবাক হয়ে শুধোলেন, হররোজ চাকরি ছাড়লে আপনার চলে কি করে? মুজতবা আলীর সরস জবাব, ‘আপনি চাকরি ছাড়া অংশটি হিসেব করেছেন, আর আমি চাকরি থাকার অংশটি হিসেব করেছি!’ পেশাগত জীবনে দীর্ঘদিন কোন একটি পেশায় না থাকা মুজতবা আলীর সম্পর্কে খানিক ধারনা পাওয়া যায় এখানে। বরোদায় অধ্যাপনা করেছেন, বগুড়া কলেজে পড়িয়েছেন, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন, এমনকি নিজের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিশ্বভারতীতে জার্মান ভাষার অধ্যাপক ও পরে ইসলামি সংস্কৃতির অধ্যাপক হয়েছিলেন। এছাড়া ছিলেন কটক ও পাটনায় অল ইন্ডিয়া রেডিয়োর স্টেশন ডাইরেক্টর। এই বিচিত্র পেশায় থাকার ফলে তার বন্ধুতালিকা ছিল সমৃদ্ধ। সঙ্গীতজ্ঞ ওস্তাদ ফৈয়াজ আলী খান, পণ্ডিত রবিশংকর, মৌলানা আবুল কালাম আজাদ সহ দেশবিদেশের অসংখ্য জ্ঞানীগুণি মানুষের সান্নিধ্য লাভ করেছিলেন। শিক্ষকদের মত তার বন্ধুতালিকাও একইরকম তারায় তারায় খচিত।

২.
মুজতবা আলী কেবল সাহিত্যিক নন, রচনা-সাহিত্যিক। অথবা কেবলই রচনাকার। এই লাইনটিকে যদি সূচনাদ্বার ধরি তবে মুজতবা রচনার অনেক বৈশিষ্ট এককথায় বলা হয়ে যায়। সামান্য আলু-পেঁয়াজ-নুনের স্যালাড থেকে দুর্পাঠ্য দর্শন সবটাতেই তার সমান কব্জির জোর, যে কোন রচনাকে তিনি ঋদ্ধ রমণীয় করে তুলবেন এমনটাই যেন তার প্রতিজ্ঞা । সেই সামান্য রচনাতে রেখে যাবেন তার প্রাচীন ও নবীন শিক্ষাগ্রহণের ছাপ। বাক্যে আর শব্দের ব্যবহারে এমন কিছু কুশলতা দেখিয়ে যাবেন, তথ্য ও তত্বের এমন একটি সম্মিলন ঘটাবেন যে নবীন কিংবা প্রবীণ সকলের জন্যই কিছু না কিছু প্রাপ্য থাকবে সেখানে।

পাণ্ডিত্য অবশ্যই শ্রদ্ধার যোগ্য, কিন্তু সেই পাণ্ডিত্যকে রসের আবরণে ঢেকে নিয়ে সহজ ভাবে পাঠকের কাছে পৌঁছে যাওয়ার জন্যই মুজতবা পাঠকের কাছে আজও এত জনপ্রিয়। অগাধ জ্ঞান নিয়েও স্বাভাবিক হাসি ঠাট্টার মাঝে নিজেকে ধরে রাখার ফলে পাঠক সহজেই তাকে আপন করে নিতে পারে। তাই বলে তাঁর রচনা খেলো কিংবা চটুল নয়, বরং একটি স্থায়ী দূরত্ব রচনা করেই তিনি সাধারণের ভাষায় কথা বলেন। যা কিনা একজন শিক্ষকের চিহ্ন। তাঁর রচনার আরেকটি বিরাট বৈশিষ্ট্য যেটি তাকে বাংলাভাষায় নিজস্ব একটি আসন দিয়েছে, মজলিসি গদ্য। তাঁর লেখা পড়ার সময় আড্ডার যে স্রোত সেটা টের পাওয়া যায় অনায়াসে। আরবি ফার্সির জমাট ব্যবহার যা ভাষাকে আড়ষ্ট না করে একটি বিশ্বদর্শন দেয়, মুখের ভাষাকে তুলনারহিতভাবে লেখার পাতায় নিয়ে আসায় আড্ডার একটি একান্ত অনুভূতি যোগায়।

বিপুল পাঠের অভ্যাস থাকায় তার রচনায় থাকে বহুশাস্ত্রের নানান সূত্র, নানা ভাষা ও সাহিত্যের উপাদান মিলে মিশে একটি পূর্ণছবি তুলে ধরার প্রয়াস তাঁর রচনায় লক্ষণীয়। সামান্য স্যালাডের রেসিপি লিখতে বসেও যিনি তুলনামূলক ভাষার প্রসঙ্গে আসতে পারেন, নিখাঁদ প্রেমের উপন্যাস লিখতে বসে যিনি গভীর তত্ত্বকথায় ডুবে যেতে পারেন আবার দক্ষ শিল্পীর মত তিনিই আবার মাপা কয়েকটি শব্দে একটি দৃশ্য পাঠকের চোখের সামনে তুলে ধরতে পারেন, এইসব নকশা-কারুকাজ থাকার ফলেই পণ্ডিতেরা তার রচনাকে অভিহিত করেছেন ‘বেলে লেৎরস’ বা ‘মঞ্জুভাষা’ বলে।

এতসব হাসি-আনন্দের আয়োজন থাকা সত্যেও তার রচনার মূল সুরটি কিন্তু হাসি কিংবা আনন্দের নয়। বরং একটু তলিয়ে দেখতে গেলেই দেখা যাবে তার আপাত হাস্যরসের আড়ালে যে অন্তসলিলা ধারাটি বয়ে চলেছে, সেটি অশ্রুর। খানিকটা বিদ্রূপ, কতক অট্টহাসির পেছনে যে মুখছবিটি আমাদের সামনে আসে সেটি অশ্রুভেজা, কান্নাধোয়া৷ ‘কত না অশ্রুজল’ নামের বইটি এর অনন্য উদাহরণ। ‘অবিশ্বাস্য’ উপন্যাসটিতেও এই পীড়িত হৃদয়ের দেখা পাওয়া যায়৷ কিংবা বলা যায় ‘পাদটীকা’ গল্পটির কথা। যেখানে পুরো গল্পটি একটি অসহায় শিক্ষকের বিড়ম্বনাকে নিয়ে লেখা, কিন্তু তার শেষ লাইনে গিয়ে মুজতবার সেই জগতের অবিচার নিয়ে অট্টহাসির বিষয়টি গোপন থাকেনি। বরং কুকুরের এক পায়ের সমান সংস্কৃতের পণ্ডিতমশাইয়ের দীর্ঘশ্বাস কোন মন্ত্রবলে পাঠকের হৃদয়ে গিয়ে প্রবেশ করেছে।

অগাথ পাণ্ডিত্য, বিপুল ভাষাজ্ঞান, অজস্র শাস্ত্র, সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতা থাকার পরেও স্বচ্ছতোয়া ঝর্ণার মত তার রচনার অবাধ গতি, পাঠকের হৃদয়ে অনায়াসে প্রবেশ করার ক্ষমতার কল্যাণে আজও বাঙালি পাঠকের কাছে মুজতবা আদরণীয়। এই অনিঃশেষ মুগ্ধতা নিশ্চয়ই টিকে থাকবে আরও বহুদিন। বাংলাভাষার পাঠক এই ভাষায় এমন একজন লেখকের জন্ম হওয়ার জন্য শ্লাঘবোধ করবে আরও বহুদিন। ততদিন পর্যন্ত মুজতবাচর্চা তামাম ন শুদ…

সূত্র : সৈয়দ মুর্তাজা আলী রচিত জীবনি। রচনাবলি প্রথম খণ্ডে গজেন্দ্রকুমার মিত্রের ভূমিকা।

Hot this week

নীল শাড়ি রূপা আর এক হিমালয়ের হিমু

সেদিন হিমালয় থেকে হিমু এসেছিল। মো. মোস্তফা মুশফিক তালুকদার। মাথার উপর...

সিজিপিএ বনাম অভিজ্ঞতা — মাহফুজা সুলতানা

বন্ধু, তোমার সিজিপিএ আমায় ধার দিও। বিনিময়ে,আমার থেকে অভিজ্ঞতা নিও।...

‘দেবী’কথনঃ একটু খোলামেলাই!

জুবায়ের ইবনে কামাল আপনি কি দেবী সিনেমা নিয়ে আমার মতই...

শরৎকাল: কাশের দেশে যখন প্রকৃতি হাসে !

ইভান পাল || আজ কবিগুরুর একটা গান ভীষণ মনে পড়ছে--- "আজি...

মাওঃ সাদ সাহেবের যত ভ্রান্ত উক্তি

বেশ কিছুদিন যাবৎ মাওঃ সাদ সাহেবকে কেন্দ্র করে তাবলীগ...

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আরপিএল: সম্ভাবনা ও গুরুত্ব

আরপিএল বর্তমান বিশ্বে দক্ষ মানবসম্পদ গঠনের জন্য প্রথাগত শিক্ষার পাশাপাশি...

কালীগঞ্জে শিক্ষার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে অভিভাবক সমাবেশ

গাজীপুরের কালীগঞ্জে ঐতিহ্যবাহী ‘নরুন সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে’ শিক্ষার মানোন্নয়নের...

দৈনিক যায়যায়দিনের ডিক্লারেশন ফিরে পেলেন শফিক রেহমান

দৈনিক যায়যায়দিনের ডিক্লারেশন ফিরে পেলেন বর্ষিয়ান সাংবাদিক শফিক রেহমান।...

বিয়ের কাজ সারলেন তালাত মাহমুদ রাফি

বিয়ে করেছেন সমন্বয়ক তালাত মাহমুদ রাফি। সোমবার (১৭ মার্চ)...

যুদ্ধ বন্ধে পুতিনের সাথে কথা বলবে ডোনাল্ড ট্রাম্প

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জানিয়েছেন, তিনি আগামীকাল মঙ্গলবার রুশ...

সিআইডি প্রধান হলেন গাজী জসীম

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন...

দেশের মাটিতে পা রাখলেন হামজা চৌধুরী

অবশেষে অপেক্ষার প্রহর শেষ হলো। দেশের মাটিতে পা রাখলেন...

পিরোজপুরে শিশু ধর্ষণের অভিযোগে পিতা-পুত্র আটক

পিরোজপুরের ইন্দুরকানীতে সপ্তম শ্রেণির এক মাদ্রাসা শিক্ষার্থীকে জোর করে...
spot_img

Related Articles

Popular Categories

spot_imgspot_img