মাশরুর হোসাইন
সবার জীবনেই কোনো না কোনো পরীক্ষায় একবার করে হলেও ক্লাইমেট চেঞ্জ, গ্লোবাল ওয়ার্মিং, গ্রিন হাউজ গ্যাস – এসব প্যারাগ্রাফের একটি হলেও লিখতে হয়েছে। আবার প্রায় আমরা সবাইই সেই প্যারাগ্রাফ বা রচনা অনেক কষ্ট করে মুখস্ত করে পরীক্ষার খাতায় লিখে দিয়ে এসে ক্ষান্ত হয়েছি। বড়জোর হয়তো খুব কষ্ট পেয়েছি আমাদের এ সুন্দর পৃথিবীর এতো দুর্দশার কথা চিন্তা করে। আজ বলবো সেই মেয়েটির গল্প, যে মেয়েটি ক্লাইমেট চেঞ্জের উপর শুধু রচনা লিখেই বসে থাকেনি, বরং পৃথিবীটাকে বাঁচানোর সাহস দেখিয়েছে।
বলছি সুইডেনের অদম্য কিশোরী, গ্রেটা থুনবার্গের কথা। ২০১৮ এর মে মাসে সুইডেনের একটি পত্রিকা জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক এক রচনা প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। গ্রেটা সেই প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়। সেই থেকেই শুরু। সে বছরের আগস্টে সুইডিশ পার্লামেন্টের সামনে “skolstrejk för klimatet” অর্থাৎ, “জলবায়ুর জন্য স্কুল-ধর্মঘট” লেখা ব্যানার নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে গ্রেটা। শুরুতে কয়েকজন পথচারীর করুণা আর পরিবার পরিজনের নিরুৎসাহ ছাড়া তেমন কিছু না পেলেও, সে চিত্র বদলাতে বেশি সময় লাগেনি। এক সপ্তাহেরও কম সময়ে গ্রেটার পাশে তার মতো মানুষগুলো এসে দাঁড়াতে শুরু করে, প্রতিধ্বনিত হতে থাকে তার স্লোগান। গ্রেটার নেতৃত্বে প্রতি সপ্তাহের শুক্রবার চলতে থাকে পৃথিবীকে বাঁচানোর এ লড়াই। এভাবেই মাত্র তিন মাসের মধ্যে নভেম্বরে বিশ্বের ২৪টি দেশের ১৭,০০০ এরও বেশি ছাত্রছাত্রী অংশ নেয় গ্রেটার এই ধর্মঘটে। ডিসেম্বরে জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলনে গ্রেটা বক্তব্য রাখে এবং জলবায়ু সমস্যাকে মানবজাতির জন্য সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বিপর্যয় হিসেবে আখ্যায়িত করে।
এখানেই শেষ নয়। গ্রেটার নেতৃত্বে, এ বছরের মার্চ মাসে বিশ্বের ১৩৫টি দেশের প্রায় ২০ লক্ষেরও বেশি ছেলেমেয়ে গ্রিন হাউজ গ্যাস নিঃসরণ কমানো ও জলবায়ু সম্পর্কিত নীতিমালাসমূহকে আরো বেশি বলিষ্ঠকরণের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলে। টাইম ম্যাগাজিন গ্রেটাকে পৃথিবীর অন্যতম একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। শুধু তাই নয়, গ্রেটাকে শান্তিতে নোবেল পুরষ্কারের জন্য এ বছর মনোনীত করা হয়েছে। পোপ ফ্রান্সিস, এলন মাস্ক, বারাক ওবামা থেকে শুরু করে বিশ্বের প্রমুখ জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব গ্রেটার প্রতি তাদের পরিপূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করেছেন। গ্রেটা জন্ম থেকেই এ্যাসপার্গার সিনড্রোমে আক্রান্ত। এ রোগাক্রান্ত ব্যক্তিরা মানুষের সাথে মিশতে ও নিজেদের পরিপূর্ণভাবে প্রকাশ করতে বেশ অসুবিধার সম্মুখীন হন, একান্ত প্রয়োজন ছাড়া কোনো কথা বলেন না এবং কোনো সমস্যা নিয়ে একরোখাভাবে ভেবে যান। গ্রেটার ভাষ্যমতে এটি তার জন্য একটি ‘সুপারপাওয়ার’ – যা তাকে বিশ্বের সামনে তার বক্তব্যকে সংক্ষিপ্ত ও সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করতে সাহায্য করেছে।
আপাত দৃষ্টিতে, বিশ্বে জলবায়ু সমস্যার প্রধান কারণ অতিরিক্ত কার্বন (কার্বন ডাইঅক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড, ক্লোরো ফ্লোরো কার্বন, ইত্যাদি) নিঃসরণ। আর ইউরোপীয় পরিবেশ সংস্থা, ইইএ এর ২০১৯ সালের জরিপ অনুযায়ী, একটি যাত্রীবাহী প্লেন এক কিলোমিটার ওড়ার জন্য গড়ে ৩০ কেজি কার্বন ডাইঅক্সাইড উৎপন্ন করে। তাই গ্রেটা প্লেনে চড়তে ভীষণ নারাজ। ইউরোপের মধ্যে বিভিন্ন দেশে যাতায়াতের জন্য ট্রেনই তার প্রথম পছন্দ। এ বছর আগস্টে নিউইয়র্কে আয়োজিত জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনে অংশগ্রহণের জন্য ব্রিটেন থেকে রওনা হয় গ্রেটা, কিন্তু প্লেন বা, ট্রেনে করে নয়। বরং সম্পূর্ণ সৌরশক্তিচালিত একটি স্কুনারে (পালতোলা এক ধরনের বিশেষ নৌযান) চড়ে আটলান্টিক মহাসাগর পারি দিয়ে নিউইয়র্কে পৌঁছায় দুঃসাহসী গ্রেটা থুনবার্গ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট, বারাক ওবামা, কিছুদিন আগে গ্রেটাকে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিনিধিদের একজন বলে আখ্যায়িত করেছেন।
গ্রেটার মতোই আরো অনেক কিশোর-কিশোরী আমাদের এ পৃথিবীর হয়ে প্রতিবাদ ও পৃথিবীকে বাঁচানোর জন্য প্রতিনিয়ত অক্লান্তভাবে কাজ করে যাচ্ছে। তাদের মধ্যে অন্যতম কয়েকজন হলেন: পৃথিবীর পানিকে দূষণমুক্ত রাখার স্বীকৃতিস্বরূপ “Water Warrior” খেতাবপ্রাপ্ত, অটাম পেল্টিয়ে; যুক্তরাষ্ট্রের ইউথ ক্লাইমেট স্ট্রাইকের সহ-প্রতিষ্ঠাতা, ইসরা হারসি; শুটেজকাট মার্টিনেজ; প্রমুখ। কী ভাবছো? ওদের মতো তোমারও পৃথিবীর জন্য কিছু করতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে, তাই তো? কাজটা কিন্তু মোটেও কঠিন নয়। আজই, এখন থেকেই শুরু করে দাও। রুম থেকে বের হবার সময় মনে করে লাইট-ফ্যান নিভিয়ে দাও, অকারণে গ্যাসের চুলা যাতে না জ্বালিয়ে রাখা হয় – সে ব্যাপারে তোমার পরিবারের সদস্যদের সচেতন করো, সামান্য দূরত্বে যাতায়াতের জন্য পায়ে হেঁটে আর বেশি দূরত্ব পারি দেওয়ার জন্য বাইসাইকেলে করে চলাচলের অভ্যাস গড়ে তুলতে পারো, কার্বন নিঃসরণ করে এমন যানবাহনকে যতোটা পারো এড়িয়ে চলো। আমরাই পারি গ্রেটা থুনবার্গের স্বপ্নকে নিজেদের করে নিতে, আমাদের এ পৃথিবীকে ধীরে ধীরে পুড়ে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করে সুন্দর একটা ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতে।