যখন ওরা আমার মৃতপ্রায় অসুস্থ দাদাকে কিংবা সেই ছোট্টটি মামাকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়েই মেরে ফেলল তখন আমি কিছুই করতে পারিনি। প্রকৃতি আমায় সেই সুযোগটুকুও দিবার কথা ভাবেওনি। হয়ত আমাকে অপাংক্তেয় ভেবেছিল,ভেবেছিল এত্তোটুকুন আমি কিই বা করতে পারব। ভুল সময়ে ভুল শতাব্দীতে জন্ম নিয়ে একরকম অপরিচেয়ই ছিলাম ইতিহাসের অদ্ভুত কলমের কাছে। অনেকবার ভেবেছি পরিচয়টা সেরেই ফেলব অবুঝ ইতিহাস আর নির্বাক ভবিষ্যতের সাথে। কিন্তু তা আর হয়ে ওঠে না। হবে কি করে; যে দেশের অর্থনীতির চালকের আসনে বসা নারী শ্রমিকটিকে সকাল-সন্ধ্যা আট ঘণ্টা কাজকরে বাসায় ফিরে একটু বিশ্রামের কথা না ভেবে আবার রঙ চাপিয়ে দাঁড়াতে হয় বিশ্বের বুকে; যদি আরেকটু জীবিকার সন্ধান পাওয়া যায়! তারপর?
তারপর সূর্যোদয়। ওয়াসার পবিত্র পানিতে একটু পবিত্র হবার অনির্বার প্রচেষ্টা। আবার একটি সকাল আবার কাজে যাবার তাড়া! মা বস্তির কারো সাথে মিশতে মানা করে দিয়েছে। তাই ওদের কথা বেশীক্ষণ ভাবতে পারিনা। মা’র কথার অবাধ্য হবার মত বোহেমিয়ান তো আমি না। পড়াশুনা নিয়েই তো ছিলাম। সামান্য কিছু একটা না বুঝলেও তা নিয়ে প্রশ্ন করে করে বাড়ি মাথায় করে রাখতাম। আর যদি একটু কঠিন অঙ্ক কষতে যেয়ে আটকে যেতাম তবে তো পাশের বাড়ীর স্বপ্না আপি আছেই। আপি একটা স্বনামধন্য স্কুলের স্বনামধন্য ছাত্রী। ক্লাশ থেকে বিতর্ক, বিতর্ক থেকে পরীক্ষা কোথায় নেই আপির পদচারণা। অবশ্য শনিবার হলে বিপদেই পরে যেতাম, কেননা ওইদিন আপি প্রাইভেট পরতে যেতেন তার স্কুলেরই এক স্বনামধন্য স্যার এর কাছে। বিরাট স্কুল তো তাই তার ব্যাপার স্যাপারও অনেক বিরাট। না হয় কি স্যারের বাসা থেকে গত শনিবার আপিকে এভাবে রক্তাক্ত অবস্থায় আসতে হয়? পড়া পারেনি বলে ‘বিরাট’ স্যারটা এভাবে কাউকে মারে! জামা কাপড়ও দেখছি ছিঁড়ে গেছে। আমার ছোট মনে ভয় ঢুকে যায়। আম্মু বলেছে আগামী বছর আমাকেও বড় স্কুলে ভর্তি করে দিবে। পড়া না পারলে যদি বড় স্কুল বড় বড় স্যাররা আমাকেও এভাবে মারে! না বাবা পড়ালেখা বুঝি আমার আর করা হয়ে উঠল না। অতঃপর ছুটে চলা;আর পালিয়ে পালিয়ে বেড়ানো। তারপরও একটু একটু করে বড় বিদ্যালয়, উচ্চবিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়ও পেরোনো হয়ে গেছে। ছোটবেলার ভয়টুকু যখন কাটতে শুরু করল ঠিক তখনই আমাকে নাকি আরো একটু বড় বিদ্যালয় ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে’ ভর্তি হতে হবে! ছেলেকে নাকি মস্ত ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে- মায়ের এক কথা। মায়ের কথার বাইরে যাবার সামর্থ্য কই? ভর্তি তো ভর্তি, আমাকে নাকি আবার বুয়েট না কি যেন বলে ওইখানে ভর্তি হতে হবে। কেননা অন্য কোথাও পড়লে নাকি আমার প্রেস্টিজ থাকবে না। পিচ্চি ছেলে তার আবার প্রেস্টিজ! এতোকিছুর মাঝেও কেউ একজন চুপি চুপি আমায় পরিচিত হতে বলছে। একটু জিরিয়ে নেবার জন্য বকছে। কিন্তু বড্ড ব্যস্ত আমার একটু জিরিয়ে নেবার সময় কোথায়? বৃষ্টিতে ভেজা কিংবা জোসনা দেখা? সেতো বিলাসিতা! আমিও প্রতীক্ষায় প্রহর কাটাচ্ছি সেইদিনটির যেদিন রাগ ভুলে আবারও আমায় অঙ্ক কষে দিবে স্বপ্নাপি; অপেক্ষায় থেকো সেইদিনটির যেদিন তুমি আমি জানালা কিংবা বারান্দার ফাঁকে নয় ডুব দিব বিশাল আকাশটির সত্যিকারের বিশালত্বে আর ভেসে বেড়াবো মেঘের ভেলায়…।।
লেখকঃ তানজিম রিফাত
ছাত্র, আহসানুল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।