আমি প্রায় ৮ মাস পর বাসায় ঢুকেছি। ৮ মাস পর বাসার সবকিছু একটু অন্যরকম লাগার কথা। লাগছে না, সবই আগের মতো। রান্নাঘরে টগবগ করে ডাল ফুটছে, পাশের রুমে কেউ নেই অযথাই ফ্যান ঘুরছে, বেসিনের নল দিয়ে অনবরত টপটপ করে পানি পড়ছে।
৮ মাস আমি কোথায় ছিলাম তা না বললেও চলে। কিন্তু বলতে হচ্ছে। ৮ মাস কারাগারে ছিলাম। আমার কারাগার থেকে ছাড়া পাওয়াটা তেমন উল্লেখযোগ্য বিষয় না। কেউ কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে ফুলের মালা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে তা আশাও করি না। এমনকি ঘরের ভেতর ঢোকার পর আমাকে দেখে কারো কোন প্রতিক্রিয়া হতে পারে তাও আশা করি না। আমি সাংবাদিক মানুষ। কড়া করে দুয়েকটা কথা লিখে ফেলি। তখন সমাজের স্বনামধন্য ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা চুরি, ছিনতাই থেকে শুরু করে যেকোন একটা অভিযোগে ঢুকিয়ে দেয় হাজতে। তাই কারাগার আমার কাছে হয়ে গিয়েছে ‘মামাবাড়ি’। যাওয়া আসা চলতে থাকে। ধীরে ধীরে পরিবারও এটা মেনে নিয়েছে। লেখালেখি করলে শাস্তি পেতে হবে, অপমানিত হতে হবে, হাজতে বাস করতে হবে। স্কুল-কলেজে কোন কারণে ফেল করে গেলেও দোষ পড়ে যেত লেখালেখির।
অন্যসময় হাজতে কম সময় রাখে। দুই মাস কিংবা তিনমাস। এবার অভিযোগ কয়েকটা চাপিয়ে দেওয়ায় বেশ কতটা দিন কাগজ-কলমের স্পর্শ ছাড়া থাকতে হয়েছে। শুরুর দিকে নিজের উপর চাপানো অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখতাম, নিজেকে সঠিক প্রমাণ করার চেষ্টা করতাম। এখন তাও করি না। যতদিন ধরে রাখবার রাখবে, যখন ছাড়বার ছাড়বে। ৮ মাস আগে ওভার ব্রিজ তৈরীর টাকা গুম করে দেওয়া নিয়ে ‘ওভারব্রিজ হচ্ছে সেই কবে থেকে’ শিরোনামে যেই লেখাটা ছাপা হয়েছিলো সেটার দায়ে গ্রেফতার হয়েছিলাম। যদিও অভিযোগ দিয়েছিলো আমি আমি মাদক ব্যবসায়ী। পরে আরো কিছু অভিযোগ দিয়ে আটকে রাখা হয় আমাকে। আমি জানতেও চাইনি সেই অভিযোগগুলো কী।
সাংবাদিক জেলে যায়, উদ্যোক্তা জেলে যায়, ছাত্ররা জেলে যায়। জেলখানা মামাবাড়ি না। সেখানে কেউ যায় না। তাদেরকে পাঠায়। পুলিশের প্রমোশন দেখেছেন। ডিমোশন কি দেখেছেন? আমি দেখেছি। থানার এস.আই ছিলেন যে লোকটা সে এখন গণভবন এর সিকিউরিটি গার্ড। কারণ তাঁকে পাঠানো হয়েছিলো আসামী ধরে আনতে। তিনি ফিরেছিলেন খালি হাতে। তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলো, “আসামী কোথায়?” উত্তরে তিনি বলছিলেন, “আমাকে যেখানে পাঠানো হয়েছিলো সেখানে কোন আসামী ছিলো না।” “তাহলে যেকোন একজনকে ধরে আনতেন, খালি হাতে ফিরলেন কেন!” এস.আই বলেছিলেন, “এটা আমার দ্বারা সম্ভব না।” “তাহলে এটা আপনার জায়গা না, আপনি গণভবনে যান।” অত:পর ডিমোশন।
এই বিষয়টা নিয়ে আমার লেখাটা ছাপা হবে, আমি আবার বন্দি হবো কারাগারে। কিংবা আমার ছোট ছেলেটাকে ধরে নিয়ে গিয়ে ফোনে আমাকে বলবে, “ছেড়ে দে সাংবাদিকতা, ছেড়ে দে কলম।”
হলুদ আর রসুন দেওয়া ফুটন্ত ডালের গন্ধ চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। আমি ডালের সুবাস নিতে নিতে কাগজ-কলম নিয়ে বসে গেলাম। আমার ঘরে প্রতিদিনই ডাল রান্না হবে, আমি প্রায়ই কারাগার থেকে ফিরে ফুটন্ত ডাল দেখবো।
লেখা-এশনা বিনতে আলী