সকাল বেলা চা খেতে খেতে আয়েশ করে পত্রিকা পড়েন আকবর সাহেব, খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে এক্সারসাইজ করা শেষে রুটি-মাখন খেয়ে পত্রিকা নিয়ে রকিং চেয়ারে দুলতে দুলতে আয়েশ করে চায়ের কাপে চুমুক দেয়া অভ্যাস।
ইদানিং সুমনা বেগমের দৈনিক কাজকর্মে আকবর সাহেব একটু অবাক হন, সব কাজেই একটু ঢিলে ভাব, চা দিয়েছে ঠান্ডা, সকালে নিজেই রুটিতে মাখন লাগিয়ে দিতেন, তাও দেন নি। ব্যবসায়ী মানুষ তিনি, সকালটা পরিবারের সাথে কাটালেও দশটার থেকে রাত বারোটা পর্যন্ত বাড়ির বাহিরে থাকতে হয়, দুই ছেলে রয়েছে তার, সবাই পড়াশোনা করেন, সুখের সংসার। হটাৎ চা খেতে খেতেই চোখে পড়ে খবরটা, প্রথম পৃষ্ঠায় লেখা গতকাল বাড্ডায় পারিবারিক কলহের কারনে বাবা জামাল শেখ(৩৮) আর কন্যা(৯) জিদনী হত্যা, বাহ! আকবর সাহেব একবার আঁতকে উঠলেন, নিচেই একই সাথে আরেকটা খবর কাকরাইলে নাকি মা ছেলে একসাথে খুন, পারিবারিক সমস্যার কারণেই। তিনি চায়ের কাপে চুমুক দেন, ভাবেন একটা পরিবার, পরিবারে থাকে একটা বন্ধন, সবার জন্যই নিশ্চই আলাদা আবেগ কাজ করার কথা। তার প্রথম ছেলে আসাদ যখন আসে পৃথিবীতে তিনি আর সুমনা তো হাউমাউ করে কেঁদেই দিয়েছিলেন আনন্দে, আবার আশফাক এর যখন সাইকেল ধাক্কায় পা মচকে গেল, তিনি বাবা বলেই হয়ত টের পেয়েছেন নিজের ভেতরে কোথাও হয়ত মোচড়ামুচরি শুরু হয়ে গিয়েছে। পত্রিকা উল্টালেন বিস্তারিত খবর পড়ার জন্য। ৩৮ বছর বয়সের জামাল শেখ ছিলেন গাড়ির ড্রাইভার। আর্জিনা বেগমের সাথে বিয়ে হয়েছিল বছর বারো আগে, শুরুতে পরিবার সমস্যা করলেও পরে নাকি ঠিক হয়ে গিয়েছিল, জামাল শেখ গাড়ি চালান, সুদের কারবার করেন, আবার পরিবারের বাহিরে একজন মানুষকেও বাসা সাবলেট দিয়েছেন। হত্যাকাণ্ডের পর থেকে লোকটি গায়েব। আর্জিনা বেগমের কথায় ঘরে চারজন ডাকাত এসেছিল, তাকে অজ্ঞান করে স্বামী আর কন্যাকে হত্যা করে চলে গিয়েছে। ঘরে আর কোন সমস্যা নেই, টাকা পয়সা চুরি, লকার ভাঙা কিংবা আর কিছু।আসল ঘটনা আন্দাজ করা যায়। খালি দুটি খুন। পত্রিকায় ছোট নয় বছরের জিদনীকে দেখে আকবর সাহেব মনে মনে ভাবেন, আহারে মা, এত ফুটফুটে চেহারার একটা বাচ্চারে নেকড়ে ছাড়া কেউ ছোঁয়ার সাহস পাবে না। কি সুন্দর মায়াকাড়া চেহারা। তিনি চায়ের কাপে আবার চুমুক দেন, ঠান্ডা হয়ে গেছে চা। কিন্তু খেয়াল নেই। গত পরশুদিনের কাকরাইলে মা ছেলে হত্যার খবর সামনে, শামসুন্নাহার আর তার ছোট ছেলে সাজেদুল করিমের বাবা করিম সাহেব ছিলেন আদার ব্যাপারী, আদার ব্যাপারী এখন জাহাজের ব্যবসা না করলেও অনেক অনেক ক্ষমতা রাখেন, রাখেন তিনজন স্ত্রীও। প্রথম স্ত্রী শামসুন্নাহারের নামে ছিল বাড়ি, দোকান, কোল্ডস্টোরেজ। করিম সাহেব অনেকদিন ধরেই চাপ দিচ্ছিলেন ফিরিয়ে নিতে।
আচ্ছা, তাহলে বন্ধনে জড়ায় কেন মানুষ এই যদি শেষ হয়।
যাই হোক, চা শেষ, কাপটাও নিয়ে যায়না ইদানিং সুমনা বেগম, তিনি উঠে রান্নাঘরের দিকে এগুলেন, হটাৎ বেডরুমের পাশ দিয়ে যাবার সময় মনে হলো তার স্ত্রী কারো সাথে কথা বলছেন হেসে হেসে, আত্মীয়-স্বজন যে না, কথা শুনেই বোঝা যাচ্ছে,হটাৎ হটাৎ হাসিতে ভেঙে পড়ছেন সুমনা বেগম, কথার মাঝে বারবার আদুরে আদিখ্যেতা দেখাচ্ছেন। দরজা লক করা ভিতর থেকে, আকবর সাহেব ডিস্টার্ব করলেন না, তিনি বেশ বুঝতে পেরেছেন সবকিছু। কয়দিন আগে যখন দেখলেন পত্রিকায় দারুস সালাম এ দুই ছেলে আর মা মিলে সম্পত্তির জন্য বাবাকে খুন করে ফেলেছেন, ফেব্রুয়ারি মাসেও মালিবাগে স্ত্রীর হাতে স্বামী খুন, এই গত ছাব্বিশ তারিখেও তো এক স্ত্রী স্বামীকে খুন করে ফেলেছেন। আকবর সাহেবের মাথা গরম হতে শুরু করে, চায়ের কাপ ধরা হাত থরথর করে কাঁপতে থাকে। তিনি মনে মনে অংক কষতে শুরু করেন, নিজের ছবি পত্রিকায় দেখতে চান না বলেই রান্নাঘরে চায়ের কাপ রেখে ছুরিটা নিয়ে দরজার পাশে বসে রইলেন চুপ করে।
লেখা: ফিদা আল মুগনি
তথ্য-প্রথম আলো 3,11,17