আপসের বদলে যিনি সংগ্রামকেই জীবনের ব্রত হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। গণতন্ত্রের জন্য যিনি নিজের ঘর-সংসার, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য এবং সন্তানের মায়া ত্যাগ করে দেশের ভাগ্যাহত মানুষদের আপন স্বজন ভেবে বাংলাদেশের মাটি আঁকড়ে বেঁচে ছিলেন—তিনি চলে গেলেন। এটি কেবল তার শারীরিক প্রস্থান। মানবিকতা ও ‘আপসহীন নেত্রী’ অভিধা নিয়ে তিনি মানুষের মন ও মননে চিরস্থায়ী হয়ে থাকবেন।
গণতন্ত্রের অতন্দ্র প্রহরী, তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বাংলাদেশ জাতীয়বাদী দল বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার অনন্তযাত্রায় রাজধানী ঢাকা যেন হারিয়ে ফেলেছে তার চিরচেনা কোলাহল। যানজট, ব্যস্ততা, হর্নের শব্দ—সব কিছু থমকে গেছে। সকাল থেকেই শহরের আকাশ-বাতাসে ছিল এক ভারী নীরবতা। মনে হচ্ছিল, পুরো ঢাকা যেন রূপ নিয়েছে এক বিশাল জানাজার মাঠে।
খালেদা জিয়ার অন্তিম যাত্রায় রাজধানীর প্রধান সড়ক থেকে শুরু করে অলিগলি, পাড়া-মহল্লা সর্বত্র নেমে আসে মানুষের ঢল। কারও চোখে অশ্রু, কারও মুখে চাপা ক্ষোভ, আবার কারও কণ্ঠে নিঃশব্দ কান্না। তরুণ, যুবক, বৃদ্ধ, নারী—সবাই যেন এক অদৃশ্য বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়েন। রাজনৈতিক পরিচয়, মতাদর্শ কিংবা সামাজিক অবস্থানের বিভাজন ভেঙে মানুষ এক কাতারে দাঁড়ায় শোক আর বেদনায়।
বিকেল ৩টা ৪ মিনিটে জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় খালেদা জিয়ার জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় ইমামতি করেন জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের খতিব মুফতি মোহাম্মদ আব্দুল মালেক। জানাজায় উপস্থিত ছিলেন খালেদা জিয়ার জ্যেষ্ঠ সন্তান ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলসহ দেশি-বিদেশি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা।
এর আগে বুধবার সকালে গুলশানের বাসভবন ফিরোজা থেকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় খালেদা জিয়ার মরদেহ আনা হয় মানিক মিয়া এভিনিউয়ে। সকাল থেকেই সেখানে শোকার্ত মানুষের ঢল নামে। সেই জনস্রোত বাংলামোটর, শেওড়াপাড়া, নিউমার্কেট, জাহাঙ্গীর গেট পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়ে মহাখালী, শ্যামলী ও মোহাম্মদপুর পর্যন্ত। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে মানুষের ঢেউ রূপ নেয় জনসমুদ্রে।
সড়কের দুই পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের হাতে দেখা যায় কালো ব্যাজ, প্ল্যাকার্ড ও ব্যানার। কোথাও কোরআন তিলাওয়াত, কোথাও দোয়া ও মোনাজাত, আবার কোথাও নীরব মিছিল—যেখানে কোনো স্লোগান নেই, আছে শুধু নিস্তব্ধতা। রাজধানীর বাতাসে সেদিন গাড়ির হর্নের চেয়ে বেশি শোনা যাচ্ছিল মানুষের দীর্ঘশ্বাস।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত, দোকানপাট—সবখানেই শোকের আবহ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। অনেক প্রতিষ্ঠান স্বতঃস্ফূর্তভাবে কার্যক্রম স্থগিত রাখে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও একই চিত্র দেখা যায়—কালো প্রোফাইল ছবি, শোকবার্তা, স্মৃতিচারণ এবং প্রশ্নে বিদ্ধ বিবেক।
খালেদা জিয়ার জানাজায় অংশ নিতে মাদারীপুরের কালকিনী থেকে আসেন ১১০ বছর বয়সী মৌলভী আব্দুর রশিদ। তিনি বলেন, ‘আমি জিয়াউর রহমানের ভক্ত ছিলাম। তার দেশপ্রেমে মুগ্ধ হতাম। তার মৃত্যুর পর জানাজায় অংশ নিয়েছিলাম। সেই দেশপ্রেমই আমি খালেদা জিয়ার মধ্যেও দেখেছি। তিনি কখনো নৈতিকতাকে বিসর্জন দেননি।’
ঢাকার অদূরের উপজেলা সাভার থেকে ভাঙা পা নিয়ে জানাজায় আসেন তরিকুল ইসলাম। ভূমিকম্পে আহত হয়ে পায়ে স্ক্র্যাচ ভর দিয়ে তিনি বলেন, ‘সাভার থেকে ভ্যানে, তারপর গাবতলী থেকে হেঁটে এসেছি। জানাজায় অংশ নেওয়াই আমার দায়িত্ব মনে হয়েছে।’
খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে দেশের গণমাধ্যমের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও ব্যাপকভাবে খবর প্রকাশিত হয়। ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসি জানায়, রাষ্ট্রীয় শেষকৃত্যে বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রীর প্রতি বিপুল মানুষের শোক প্রকাশ। কাতারভিত্তিক আল জাজিরা উল্লেখ করে, খালেদা জিয়ার জানাজায় ব্যাপক জনসমাগম। পাকিস্তানের দ্য ডন ও জিও নিউজও জানায়, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বিদায়ে শোকাবহ জনসমাবেশের কথা।
খালেদা জিয়ার শেষ বিদায়ে অংশ নিতে ঢাকায় আসেন পাকিস্তানের স্পিকার, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, ভুটান ও মালদ্বীপের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের প্রতিনিধি, শ্রীলঙ্কা ও নেপালের সরকারি প্রতিনিধিসহ বিভিন্ন দেশের মন্ত্রী ও বিশেষ দূতরা। রাজধানী সাক্ষী থাকে ইতিহাসের এক শোকাবহ জনসমাবেশের।
খালেদা জিয়ার মৃত্যুসংবাদে স্তব্ধ হয়ে পড়ে দেশ। শোক জানায় বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন। দেশ-বিদেশের রাষ্ট্রনায়ক ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা পাঠান শোকবার্তা। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে ভাষণে তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেন এবং জানাজা ও দাফনের দিন সাধারণ ছুটি দেন।
প্রায় চার দশকের বেশি সময়জুড়ে খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবন ছিল সংগ্রামের। গৃহবধূ থেকে উঠে এসে তিনি হয়ে ওঠেন এক দৃঢ়চেতা নেত্রী। সংকটের মুহূর্তে দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখার নেতৃত্ব দিয়েছেন বারবার। আজ তিনি নেই। কিন্তু তার জীবনগাথা শুধু একজন রাজনীতিকের ইতিহাস নয়; এটি অগ্নিদগ্ধ সময়ের ভেতর দিয়ে এগিয়ে চলা এক নারীর সাহসী সংগ্রামের কাব্য। তিনি ফিরে আসবেন না, তবে মানুষের স্মৃতিতে, ধানের শীষে ও জাতীয়তাবাদের প্রতীকে তিনি বেঁচে থাকবেন চিরকাল


