নেহার বয়স তখন মাত্র ১০। সেদিনই সে প্রথম বুঝেছিল—স্কুল হয়তো তার জন্য নয়। মায়ের হাত ধরে রাওয়ালপিন্ডির একটি সরকারি স্কুলে ভর্তি হতে গিয়েছিল সে। আবেদনপত্র দেখে কেরানি বিভ্রান্ত হয়ে ওপরে তাকাল, তারপর প্রধান শিক্ষিকার কানে কিছু ফিসফিস করে বলল।
উত্তরটি এলো খুব নরম গলায়, কিন্তু আঘাতটা ছিল গভীর—‘এই লিঙ্গের জন্য আমাদের কোনো কলাম নেই।’ ফরমটি সই ছাড়াই ফিরিয়ে দেওয়া হলো। নেহা নীরবে বাড়ি ফিরল, হাতে এমন একটি স্কুলব্যাগ, যা আর কখনো ব্যবহার করা হবে না।
প্রতিটি সমাজেরই আয়না থাকে। কিছু আয়না কাচের, আর কিছু নীরবতার। পাকিস্তানে ট্রান্সজেন্ডার নাগরিকদের ঘিরে এই নীরবতা এখন কানে তালা লাগিয়ে দেওয়ার মতো। প্রতিদিন সকালে সারা দেশে ইউনিফর্ম পরা শিশুরা স্কুলে ঢুকে পড়ে। অথচ হাজারো শিশু তাদের সকাল শুরু করে ভিন্নভাবে; স্কুলের গেট পেরিয়ে হাঁটে, যেগুলো তাদের জন্য কোনো দিনই খুলবে না।
ট্রান্সজেন্ডার শিশুদের ক্ষেত্রে আজীবন প্রান্তিকতার শুরু হয় একটিমাত্র নীরব প্রত্যাখ্যান দিয়ে; এমন একটি মুহূর্ত, যা এতটাই স্বাভাবিক বলে ধরে নেওয়া হয় যে, খুব কমই ক্ষোভ জাগায়, অথচ তাদের পুরো জীবনের গতিপথ নির্ধারণ করে দেয়।
এই বঞ্চনার পরিসংখ্যান ভয়াবহ। রাওয়ালপিন্ডি ও ইসলামাবাদে প্রায় ৭৮ শতাংশ ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তি শারীরিক হামলার শিকার হওয়ার কথা জানিয়েছেন, আর ৯১ শতাংশের বেশি বলেছেন, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে তারা কোনো না কোনোভাবে বৈষম্যের মুখে পড়েছেন।
যে স্কুল ও সামাজিক পরিসরগুলো অন্তর্ভুক্তির জায়গা হওয়ার কথা, সেগুলোই অনেক সময় প্রথম প্রত্যাখ্যানের মঞ্চ হয়ে ওঠে। শ্রেণিকক্ষ হয়ে পড়ে নিঃসঙ্গ, শৌচাগার অনিরাপদ, আর শিক্ষকরা বুলিং ঠেকাতে অপ্রস্তুত; যা প্রায়ই মজা বা ঠাট্টা বলে উড়িয়ে দেওয়া হয়।
এর ফলে এই শিশুদের বিচ্ছিন্নতাই স্বাভাবিক বলে প্রতিষ্ঠিত হয়।
এই বাস্তবতা একটি গভীর সত্যের দিকে ইঙ্গিত করে। ভিড়, পুরনো পাঠপদ্ধতি আর অসম সুযোগে জর্জরিত পাকিস্তানের শিক্ষাব্যবস্থা এখনো পরিচিত গণ্ডির বাইরে থাকা শিশুদের স্বাগত জানানোর সদিচ্ছা খুঁজে পায়নি। এটি কেবল প্রশাসনিক ব্যর্থতা নয়; এটি একটি কাঠামোগত সিদ্ধান্ত, যা নীরবে হাজারো জীবনের গতিপথ নির্ধারণ করে দেয়।
পাকিস্তানে প্রায় প্রতি পাঁচজন ট্রান্সজেন্ডারের চারজনই কখনো স্কুলে যায় না। কৈশোরে অনেককেই বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়, ঠেলে দেওয়া হয় অনিরাপদ ও মর্যাদাহীন জীবিকায়। ইউএনডিপি এই অবস্থাকে অর্থনৈতিক কারাবন্দিত্ব বলেছে। কিন্তু এই বন্দিত্ব শুরু হয় অর্থনীতি দিয়ে নয়; শুরু হয় সেদিন, যেদিন একটি শিশুকে বলা হয়—শ্রেণিকক্ষে তার জন্য কোনো জায়গা নেই।
সিএ/এএ


