বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ইন্তিকাল করেছেন। ৮০ বছর বয়সে ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়। দীর্ঘ চার দশকের বেশি সময় ধরে দেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে তিনি গৃহবধূ থেকে উঠে আসেন অন্যতম প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেত্রী হিসেবে।
গৃহবধূ থেকে রাজনীতিতে নেমে মাত্র এক দশকের মধ্যেই খালেদা জিয়া বিএনপিকে রাষ্ট্রক্ষমতায় নিয়ে যান। তাঁর নেতৃত্বে বিএনপির প্রথম মেয়াদে সরকার গঠনের সময় দেশে পুনরায় সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা চালু হয়, যা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় হিসেবে বিবেচিত।
১৯৮১ সালে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ও তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর দলটি গভীর সংকটে পড়ে। অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও রাজনৈতিক বিভাজনের মধ্যে বিপর্যস্ত বিএনপিকে সংগঠিত রাখতে খালেদা জিয়া নেতৃত্বে আসেন। বিশ্লেষকদের মতে, ক্ষমতার বলয়ের ভেতর থেকে তৈরি হওয়া বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা ছিল নির্ণায়ক। তবে তাঁর নেতৃত্বাধীন বিএনপির সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীসহ ধর্মভিত্তিক বিভিন্ন দলের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক নিয়েও সমালোচনা ছিল।
পুতুল থেকে খালেদা জিয়া
৩৬ বছর বয়সে বিধবা হন খালেদা জিয়া। তখন তিনি ছিলেন একজন সাধারণ গৃহবধূ। দুই সন্তান তারেক রহমান ও আরাফাত রহমানকে নিয়ে ছিল তাঁর সংসার। তাঁর পুরো নাম ছিল খালেদা খানম। পরিবার ও আত্মীয়দের কাছে তিনি পরিচিত ছিলেন পুতুল নামে।
১৯৬০ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন জিয়াউর রহমানের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। বিয়ের পর স্বামীর নামের সঙ্গে মিলিয়ে তিনি খালেদা জিয়া নাম গ্রহণ করেন বলে তাঁর বড় বোন সেলিমা ইসলাম জানিয়েছেন। রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত ছিলেন না। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সময়ও তিনি রাজনীতির বাইরে ছিলেন।
সমালোচকদের একটি অংশের দাবি ছিল, স্বামী জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর উত্তরাধিকার সূত্রেই তিনি বিএনপির নেতৃত্ব পান। তবে সাংবাদিক মাহফুজ উল্লাহ তাঁর জীবনীগ্রন্থে উল্লেখ করেছিলেন, অল্প বয়সে বিধবা হয়ে পুরুষশাসিত সমাজে একটি রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে এসে যোগ্যতার মাধ্যমে নিজের অবস্থান তৈরি করেছিলেন খালেদা জিয়া।
দলের বিপর্যয়ে হাল ধরেছিলেন
জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর বিএনপিতে অভ্যন্তরীণ কোন্দল তীব্র আকার ধারণ করে। একদিকে অনেক নেতা সামরিক শাসক জেনারেল এরশাদের সঙ্গে যোগ দেন, অন্যদিকে দল সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। এই প্রেক্ষাপটে ১৯৮৩ সালের ৩ জানুয়ারি খালেদা জিয়া বিএনপিতে যোগ দেন। প্রথমে তিনি ভাইস চেয়ারম্যান হন এবং ১৯৮৪ সালের ১০ মে বিএনপির চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন।
বিএনপির সাবেক নেতা অলি আহমেদ জানিয়েছেন, বিএনপিকে টিকিয়ে রাখতে পরিবারের ঘনিষ্ঠজনদের অনুরোধেই খালেদা জিয়া রাজনীতিতে আসেন। তাঁর জন্ম ১৯৪৬ সালের ১৫ আগস্ট তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের জলপাইগুড়িতে। বিএনপির তথ্য অনুযায়ী, তাঁর বাবা ইস্কান্দর মজুমদার ও মা তৈয়বা মজুমদার। তাঁদের আদি নিবাস ফেনী জেলার ফুলগাজী উপজেলায় এবং স্থায়ী বসবাস ছিল দিনাজপুর শহরের মুদিপাড়া এলাকায়। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়।
বিএনপির নেত্রী সেলিমা রহমান জানিয়েছেন, রাজনৈতিক ব্যস্ততার মধ্যেও খালেদা জিয়া পারিবারিক দায়িত্ব পালনে সব সময় সক্রিয় ছিলেন।
আপসহীন নেত্রী হিসেবে পরিচিতি
১৯৮২ সালে বিএনপির নেতৃত্ব নেওয়ার সময় দেশে চলছিল জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসন। নয় বছরের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে খালেদা জিয়া নিজেকে এবং দলকে রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করেন। ১৯৮৩ সালে তিনি সাত দলীয় ঐক্যজোট গঠন করে এরশাদবিরোধী আন্দোলন শুরু করেন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আট দলীয় জোট এবং বামপন্থীদের পাঁচ দলীয় জোটও আন্দোলনে ছিল।
১৯৮৬ সালে আওয়ামী লীগের জোট এরশাদের অধীনে নির্বাচনে অংশ নিলেও বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট নির্বাচন বর্জন করে রাজপথের আন্দোলনে অবিচল থাকে। এর ফলে খালেদা জিয়া আপসহীন নেত্রী হিসেবে পরিচিতি পান। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে তাঁকে তিনবার গ্রেপ্তার করা হয়।
লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমেদের মতে, এরশাদবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে খালেদা জিয়া বিএনপিকে পুনরুজ্জীবিত করেন। এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি ক্ষমতায় আসে। তিনি বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হন। ওই নির্বাচনে তিনি পাঁচটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সবগুলোতেই বিজয়ী হন।
সংসদীয় ব্যবস্থায় প্রত্যাবর্তন
১৯৯১ সালের নির্বাচনের আগে এরশাদবিরোধী তিন জোটের অঙ্গীকার ছিল সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়া। সেই অনুযায়ী পঞ্চম সংসদে সংসদ নেতা হিসেবে খালেদা জিয়া রাষ্ট্রপতি শাসিত ব্যবস্থা বাতিল করে সংসদীয় সরকার প্রবর্তনের বিল উত্থাপন করেন, যা ঐকমত্যের ভিত্তিতে পাস হয়। দীর্ঘ ১৬ বছর পর দেশে আবার সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা ফিরে আসে।
প্রধানমন্ত্রী থেকে বিরোধী নেতা
প্রথম সরকারের শেষদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনের মুখে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ষষ্ঠ সংসদ গঠন করে খালেদা জিয়া আবার প্রধানমন্ত্রী হন। তবে সংসদ টিকে ছিল মাত্র ১২ দিন। সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের পর তিনি ক্ষমতা হস্তান্তর করেন এবং পরবর্তী নির্বাচনে বিরোধী দলীয় নেতার দায়িত্ব নেন।
২০০১ সালে বিএনপি আবার ক্ষমতায় এলে তিনি তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে পরাজয়ের পর তিনি পুনরায় বিরোধী দলীয় নেতার ভূমিকা পালন করেন।
দুর্নীতি মামলা ও অসুস্থতা
২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় এবং ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগ সরকারের আম
সিএ/এএ


