২০২৫ সালটি ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক কঠিন পরীক্ষার বছর হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। একদিকে বাংলাদেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন, অন্যদিকে ভারতের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা অভিযানের নামে ‘পুশ-ইন’ ও ‘পুশব্যাক’ প্রক্রিয়া দুই দেশের দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে এক বড় ধরনের ফাটল সৃষ্টি করেছে।
ভারতের দাবি অনুযায়ী, কিছু ক্ষেত্রে বাংলাদেশি সুরক্ষা বাহিনী (BGB) ভারতীয় নাগরিকদের ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের ভারতীয় পাশে থেকে জোর করে বাংলাদেশের ভেতরে ঠেলে দেয় একে পুশ-ইন বলা হয়।
২০২৫ সালের মে এবং জুন মাসে ভারত থেকে বাংলাদেশে পুশ-ইনের মাত্রা তীব্র আকার ধারণ করে। বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সীমান্ত নিরাপত্তা সূত্রের তথ্য অনুযায়ী ২০২৫ সালের মে মাসের শেষ পর্যন্ত মাত্র ২৫ দিনেই প্রায় ১,২২১ জন মানুষকে বাংলাদেশের ১৮টি জেলা সীমান্ত দিয়ে জোরপূর্বক পুশ-ইন করা হয়েছে। জুন মাসের শুরুতে এই সংখ্যা ২,০০০ ছাড়িয়ে যায়।
২০২৫ সালে (জানুয়ারি-নভেম্বর পর্যন্ত) ভারতীয় সীমান্ত সুরক্ষা বাহিনী (BSF) সূত্র অনুযায়ী, প্রায় ৫,২০০ জন বাংলাদেশি নাগরিক ভারত থেকে পুশব্যাক করা হয়েছে।এর মধ্যে পুরুষ প্রায় ৪,১৫০ জন, নারী প্রায় ৭০০ জন এবং শিশু (১৮ বছরের কম)প্রায় ৩৫০জন। অন্যদিকে ভারতীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও স্থানীয় প্রশাসন থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ১৮০–২২০ জন “ভুলভাবে পুশ-ইন” করা হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে।
ভারতের গুজরাট, দিল্লি, হরিয়ানা এবং মহারাষ্ট্র থেকে তথাকথিত ‘অবৈধ অভিবাসী’ সন্দেহে লোকজনকে বিমানে বা ট্রেনে করে সীমান্তে নিয়ে আসা হয় এবং রাতের আঁধারে বিজিবিকে না জানিয়ে পুশ-ইন করা হয়। আটককৃতদের মধ্যে নারী ও শিশুর সংখ্যা উদ্বেগজনক। উদাহরণস্বরূপ, গত ৪ মে গুজরাট থেকে পাঠানো ৩০০ জনের মধ্যে ২০০ জনই ছিল নারী ও শিশু। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, আটককৃতদের মধ্যে পুরুষের তুলনায় নারী ও শিশুদের সংখ্যাই বেশি (প্রায় ৬০-৬৫%)।

২০২৫ সালের এই অভিযানের সবচেয়ে বিতর্কিত দিক হলো প্রকৃত ভারতীয় নাগরিকদের ভুলবশত বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ এবং মহারাষ্ট্রের অন্তত ৫ থেকে ৭ জন ব্যক্তির সন্ধান পাওয়া গেছে যারা জন্মসূত্রে পশ্চিমবঙ্গের নাগরিক এবং যাদের কাছে বৈধ ভারতীয় পরিচয়পত্র রয়েছে। এই ঘটনার প্রতিবাদে কলকাতা হাইকোর্টে ‘হেবিয়াস কর্পাস’ পিটিশন দাখিল করা হয় এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকারের হস্তক্ষেপে কয়েকজনকে ভারত ফিরিয়ে নেয়।
কেবলমাত্র বাংলা ভাষা বলা বা মুসলিম পরিচয় থাকার কারণে যাচাই-বাছাই ছাড়াই অনেককে আটক করা হয়, যা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
এই পুশ-ইন এবং পুশব্যাকের প্রভাব দুই দেশের সম্পর্কের ওপর বহুমাত্রিক নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
পুশ-ইনের এই প্রক্রিয়াটি বাংলাদেশে ভারত-বিরোধী মনোভাবকে উসকে দিয়েছে। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এবং সাধারণ জনগণ একে একটি ‘একতরফা ও আগ্রাসী’ পদক্ষেপ হিসেবে দেখছে।
২০২৫ সালের ডিসেম্বরের দিকে সম্পর্কের অবনতি এতটাই চরমে পৌঁছায় যে, নিরাপত্তা অজুহাতে ভারত তাদের অনেক ভিসা সেন্টার বন্ধ করে দেয় এবং বাংলাদেশও কয়েকটি মিশন থেকে কনস্যুলার সেবা স্থগিত করে।
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর (সেভেন সিস্টার্স) নিরাপত্তার জন্য বাংলাদেশের সহযোগিতা অপরিহার্য। পুশ-ইন ইস্যুকে কেন্দ্র করে যদি গোয়েন্দা সহযোগিতা কমে যায়, তবে সেটি ভারতের নিজস্ব নিরাপত্তার জন্যই ঝুঁকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।
জোরপূর্বক পুশ-ইন করার ফলে সীমান্তে নিয়মিত বিবাদ এবং উত্তজনা সৃষ্টি হচ্ছে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো এই ‘পুশব্যাক’ প্রক্রিয়াকে বিনা বিচারে নির্বাসন হিসেবে আখ্যা দিয়েছে, যা ভারতের ‘আঞ্চলিক নেতা’র ভাবমূর্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
২০২৫ সালের এই সীমান্ত সংকট কেবল একটি শরণার্থী ইস্যু নয়, এটি দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে ভারতের আধিপত্য বনাম বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের লড়াইয়ে রূপ নিয়েছে। এই সংকট নিরসনে একটি সুনির্দিষ্ট ‘যাচাইকরণ প্রক্রিয়া’ এবং উচ্চপর্যায়ের কূটনৈতিক সংলাপ জরুরি। নতুবা, সীমান্ত দিয়ে প্রবাহিত এই মানবিক সংকট দুই দেশের ঐতিহাসিক বন্ধনকে স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে
সাব্বির হোসেন, লালমনিরহাট প্রতিনিধি
সিএ/জেএইচ


