রাজনীতিতে ‘ফিরে আসা’ অনেক সময় কেবল ব্যক্তিগত প্রত্যাবর্তন নয়; কখনো কখনো তা একটি রাষ্ট্রের ভাগ্য বদলে দেওয়ার মুহূর্ত হয়ে ওঠে। বিশ্বরাজনীতির ইতিহাসে নির্বাসন, দেশত্যাগ কিংবা দীর্ঘ বন্দিত্ব থেকে ফিরে এসে বহু নেতা ক্ষমতার ভারসাম্য বদলে দিয়েছেন, কেউ গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করেছেন, কেউ আবার নতুন শাসনব্যবস্থার সূচনা করেছেন।
দূরত্ব, নিঃসঙ্গতা ও অপেক্ষার সময়কে রাজনৈতিক পুঁজি হিসেবে কাজে লাগিয়ে তাঁরা নিজেদের সংগ্রামকে করেছেন আরও দৃঢ়। ইতিহাসে এমন কয়েকটি প্রত্যাবর্তন আজও বিশ্বরাজনীতির মোড় ঘোরানো ঘটনা হিসেবে বিবেচিত।
ইরানে শাসনব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন: আয়াতুল্লাহ খোমেনি
১৯৭৯ সালে দীর্ঘ নির্বাসন শেষে ইরানে ফেরেন আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনি। তেহরানে তাঁর প্রত্যাবর্তনের কয়েক মাসের মধ্যেই পতন ঘটে শাহের রাজতন্ত্রের। প্রতিষ্ঠিত হয় ইসলামী প্রজাতন্ত্র, যা মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি ও ভূরাজনীতিতে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলে।
‘সিল করা ট্রেন’ থেকে বিপ্লবের কেন্দ্রে: ভ্লাদিমির লেনিন
সুইজারল্যান্ডে নির্বাসনে থাকা ভ্লাদিমির লেনিন ১৯১৭ সালের এপ্রিলে জার্মানির সহায়তায় ‘সিল করা ট্রেনে’ রাশিয়ায় ফেরেন। তাঁর প্রত্যাবর্তনই রুশ বিপ্লবকে ত্বরান্বিত করে, যার ফলশ্রুতিতে ভেঙে পড়ে সাম্রাজ্যবাদী শাসন এবং গড়ে ওঠে সোভিয়েত রাষ্ট্র।
কারাগার থেকে রাষ্ট্রনায়ক: নেলসন ম্যান্ডেলা
২৭ বছরের কারাবাস শেষে ১৯৯০ সালে মুক্ত হয়ে দেশে ফেরেন নেলসন ম্যান্ডেলা। প্রতিশোধের পথ বেছে না নিয়ে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকাকে এগিয়ে নেন পুনর্মিলন ও শান্তিপূর্ণ রূপান্তরের পথে। বর্ণবাদ-পরবর্তী রাষ্ট্র গঠনে তাঁর প্রত্যাবর্তন আজও নৈতিক নেতৃত্বের এক অনন্য দৃষ্টান্ত।
নির্বাসন ভেঙে গণতন্ত্রের প্রতীক: বেনজির ভুট্টো
দীর্ঘ নির্বাসন শেষে ১৯৮৬ সালে পাকিস্তানে ফেরেন বেনজির ভুট্টো। জনসমর্থনের জোয়ারে ভেসে ১৯৮৮ সালে তিনি নির্বাচিত হন প্রধানমন্ত্রী—মুসলিম বিশ্বের প্রথম নারী সরকারপ্রধান হিসেবে ইতিহাস গড়েন। পরবর্তীতে তাঁর জীবন করুণ পরিণতির দিকে গেলেও তাঁর প্রত্যাবর্তন পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক ইতিহাসে স্থায়ী ছাপ রেখে গেছে।
‘হানড্রেড ডেজ’-এর নাটকীয়তা: নেপোলিয়ন বোনাপার্ট
এলবা দ্বীপে নির্বাসন শেষে ১৮১৫ সালে নেপোলিয়নের ফ্রান্সে ফেরা ছিল রাজনৈতিক ইতিহাসের অন্যতম নাটকীয় অধ্যায়। খুব অল্প সময়ের জন্য হলেও তিনি আবার ক্ষমতা দখল করেন। যদিও সেই শাসন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি, তবু ‘হানড্রেড ডেজ’ আজও ইতিহাসে রোমাঞ্চকর অধ্যায় হয়ে আছে।
স্বৈরশাসন পেরিয়ে শান্তির দূত: কিম দে-জুং
দক্ষিণ কোরিয়ার সামরিক শাসনের বিরোধিতা করে নির্বাসিত ও নিপীড়নের শিকার হয়েছিলেন কিম দে-জুং। স্বৈরশাসনের পতনের পর দেশে ফিরে তিনি গণতান্ত্রিক রাজনীতির কেন্দ্রীয় নেতা হয়ে ওঠেন। ১৯৯৭ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে সংলাপের ‘সানশাইন পলিসি’ গ্রহণ করেন। এই উদ্যোগের স্বীকৃতি হিসেবে ২০০০ সালে তিনি নোবেল শান্তি পুরস্কার পান।
বিশ্বরাজনীতির এসব প্রত্যাবর্তন প্রমাণ করে—রাজনীতিতে ফিরে আসা কখনো কেবল অতীতের অধ্যায় নয়, বরং তা হতে পারে নতুন ইতিহাসের সূচনা।
সূত্র: বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ইতিহাসভিত্তিক দলিল
সিএ/জেএইচ


