শীত এলেই গ্রামবাংলায় শুরু হয় খেজুরের রসের মৌসুম। ভোরের কুয়াশা ভেদ করে খেজুরগাছের মাথায় ঝুলতে থাকে হাঁড়ি, আর সেই রসের খোঁজে শহরমুখী হন অনেকেই। কারও কাছে এটি শীতের বিলাস, আবার কারও কাছে শৈশবের নস্টালজিয়া। তবে এই ঐতিহ্যবাহী পানীয় কাঁচা অবস্থায় খাওয়া কতটা নিরাপদ—তা নিয়ে রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রশ্ন।
খেজুরগাছের কাণ্ডে নির্দিষ্ট কায়দায় কেটে রাতের বেলায় হাঁড়ি বসিয়ে রস সংগ্রহ করা হয়। ভোরে হাঁড়ি নামিয়ে যে রস পাওয়া যায়, সেটিই কাঁচা খেজুরের রস। এই রস স্বাদে মিষ্টি হলেও খুব দ্রুত নষ্ট হয়ে যায় এবং সহজেই জীবাণুতে আক্রান্ত হতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, কাঁচা খেজুরের রস খাওয়ার ক্ষেত্রে ঝুঁকি রয়েছে যদি তা পরিষ্কার ও সুরক্ষিত উপায়ে সংগ্রহ না করা হয়। খোলা হাঁড়িতে বাদুড়, পাখি কিংবা পোকামাকড় বসতে পারে। বাদুড়ের লালা বা মল থেকে নিপাহ ভাইরাসের মতো মারাত্মক সংক্রমণ ছড়ানোর আশঙ্কা থাকে। এ কারণে অপরিশোধিত ও খোলা অবস্থায় সংগৃহীত কাঁচা রস সরাসরি পান করা স্বাস্থ্যঝুঁকিপূর্ণ।
নিরাপদভাবে খেতে চাইলে কিছু নিয়ম মানা জরুরি। হাঁড়ি পরিষ্কার কাপড় বা বাঁশের ঢাকনা দিয়ে ঢেকে রাখলে জীবাণুর ঝুঁকি কমে। রস সংগ্রহের পর অন্তত ৫ থেকে ১০ মিনিট ফুটিয়ে নিলে ক্ষতিকর জীবাণু নষ্ট হয়। ফুটালে রঙ কিছুটা বদলালেও রস নিরাপদ হয়ে ওঠে। সংগ্রহের পর ৪ থেকে ৬ ঘণ্টার মধ্যে রস পান করা ভালো, কারণ দীর্ঘ সময় রেখে দিলে ফারমেন্টেশন শুরু হয়। পরিচিত ও পরিচ্ছন্ন গাছির কাছ থেকে নেওয়া রস তুলনামূলকভাবে নিরাপদ।
পরিমাণের দিক থেকেও সতর্ক থাকা দরকার। খেজুরের রসে প্রাকৃতিক হলেও চিনি বেশি থাকে। প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য দিনে এক কাপ বা ১৫০ থেকে ২০০ মিলিলিটার যথেষ্ট। শিশুদের ক্ষেত্রে অর্ধেক কাপের বেশি না খাওয়াই ভালো। ডায়াবেটিস রোগীদের কাঁচা খেজুরের রস না খাওয়াই উত্তম, অথবা চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। অতিরিক্ত খেলে রক্তে শর্করার মাত্রা বেড়ে যেতে পারে, পাশাপাশি পেটের সমস্যা বা ডায়রিয়া দেখা দিতে পারে।
সঠিকভাবে খেলে খেজুরের রসের উপকারিতাও রয়েছে। এটি প্রাকৃতিক শক্তির উৎস, শরীর গরম রাখতে সহায়ক এবং এতে আয়রনসহ নানা খনিজ উপাদান থাকে। শীতকালে দুর্বলতা ও ক্লান্তি কমাতে সাহায্য করে বলে গ্রামবাংলায় অনেকেই একে শীতের ‘টনিক’ হিসেবে বিবেচনা করেন।
তবে সব উপকারের পাশাপাশি সতর্কতাও জরুরি। কাঁচা ও না ফুটানো রস থেকে ভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে। অতিরিক্ত চিনি থাকায় ওজন বাড়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। সঠিকভাবে সংরক্ষণ না করলে রস দ্রুত নষ্ট হয়ে বিষাক্ত হয়ে উঠতে পারে।
যারা কাঁচা রস খাওয়ার ঝুঁকি নিতে চান না, তাদের জন্য বিকল্প রয়েছে। খেজুরের রস জ্বাল দিয়ে তৈরি পাটালি বা ঝোলা গুড় তুলনামূলকভাবে নিরাপদ ও দীর্ঘদিন ব্যবহারযোগ্য। ফুটানো রস ঠান্ডা করে পান করাও নিরাপদ একটি উপায়।
খেজুরের রস নিঃসন্দেহে শীতের এক অনন্য উপহার। তবে আবেগের চেয়ে সচেতনতা বেশি জরুরি। কাঁচা খেজুরের রস খেতে হলে এর উৎস, সংগ্রহ পদ্ধতি ও পরিমাণ সম্পর্কে জানা না থাকলে শীতের এই মিষ্টি আনন্দই অযাচিত ঝুঁকিতে পরিণত হতে পারে।
সিএ/বিই


