রংপুরের জনপথজুড়ে বিস্তীর্ণ তিস্তা এখন ভিন্ন চেহারায়। বর্ষার উত্তাল স্রোত শুকিয়ে যাওয়ার পর নদীজুড়ে জেগে ওঠা চর-ডুবোচর যেন নতুন জীবনের ইঙ্গিত দেয়। বানের পানিতে ভেসে যাওয়া কৃষকেরা এই চরেই আবার আশার বীজ বুনছেন। পলিমাটিতে উর্বর হয়ে ওঠা জমিতে আলু, মিষ্টিকুমড়া, লাউ, সরিষা, গম, ভুট্টা, চীনাবাদাম, পেঁয়াজ, রসুন, মরিচসহ নানা রকম রবি ফসল আবাদ করে ঘুরে দাঁড়াচ্ছেন তাঁরা। শুষ্ক মৌসুমের এই ফসলই বছরে একবার হলেও তাদের দুঃখ-কষ্ট কিছুটা লাঘব করে।
শুক্রবার (১২ ডিসেম্বর) সরেজমিন দেখা যায়, গঙ্গাচড়া উপজেলার মহিপুরের ৮৫০ মিটার দীর্ঘ সেতুর মাত্র ৬০ মিটার অংশ দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। আশপাশের জেগে ওঠা চরে বিস্তীর্ণ আবাদ। মর্নেয়া ইউনিয়নের ছোট রুপাই ও গজঘণ্টা ইউনিয়নের ছালাপাক এলাকায় মিষ্টিকুমড়ার বেড যেন বালুচর ঢেকে ফেলেছে। প্রতিটি বেডের মাঝখানে সাথি ফসল হিসেবে পেঁয়াজ, রসুন, লালশাক ও লাউয়ের বীজ বপন করেছেন কৃষকেরা।
শীতের বিকেলে ছোট রুপাই চরে নাতিকে নিয়ে কুমড়া ক্ষেত পরিচর্যা করছিলেন হালিমা বেগম। দুই বিঘা জমিতে কুমড়া চাষ করা হালিমা বলেন,
“চরোত এমতন করি আবাদ করিতো কোনো মতন বাঁচি আচি। অপেক্ষায় থাকি, বানের পানি কখন নামি যায়।”
পরিবারের সদস্যদের শ্রমেই তাঁদের বাঁচার পথ তৈরি হয়—এমনটাই জানালেন তিনি।
অন্যদিকে একই চরে তিন বিঘা জমিতে কুমড়া চাষ করেছেন আবুল হোসেন। তাঁর কথা, “গত বছর আলু আবাদ করি লোকসান হইচে। সেইবাদে এবার সবার আগোত কুমড়া নাগাচি, দেকি আল্লায় কী করে।”
৬৭টি চরে চলছে ব্যাপক আবাদ
কৃষি বিভাগ জানায়, গঙ্গাচড়া, পীরগাছা ও কাউনিয়া উপজেলার তিস্তা নদীর ৬৭টি চরের আট হাজার হেক্টর জমিতে ভুট্টা, গম, বাদাম, তিল, তিসি, মিষ্টিকুমড়া, লাউ, বাঁধাকপি, মুলা, গাজর, পেঁয়াজ, রসুনসহ নানা শাকসবজি উৎপাদন হয় সোয়া লাখ টন। বাজারমূল্য প্রায় ৩০০ কোটি টাকা। তিন উপজেলায় প্রায় ৩০০ হেক্টর জমিতে চলছে মিষ্টিকুমড়া আবাদ। সেপ্টেম্বর থেকে পানি কমে চর ভেসে ওঠে, আর অক্টোবর-নভেম্বর থেকে শুরু হয় আবাদ। মার্চে শেষ ফসল তোলা হয়, মে-জুনে আবার চর ডুবে যায়।
লক্ষ্মীটারীর মহিপুর এলাকায় কেউ বালু কেটে গর্ত তৈরি করে পলিমাটি এনে বেড তৈরি করছেন, কেউবা বেড়ে ওঠা ক্ষেতে সেচ দিচ্ছেন। একই সঙ্গে চলছে পেঁয়াজ-রসুন বপনের প্রস্তুতি।
কম খরচে বেশি লাভ
কৃষক নজরুল ইসলামের হিসাব, একেকটি কুমড়ার গাছে আট থেকে ১০টি কুমড়া হয়। প্রতিটি তিন থেকে চার কেজি ওজনের। ক্ষেতেই ১৫–২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করা যায়। বালুচরে কম খরচে বেশি লাভ—তাই মিষ্টিকুমড়া এখন কৃষকের নির্ভরতার জায়গা।
শংকরদহ চরে ৮০ শতকে পেঁয়াজ-রসুন চাষ করছেন আহাদ আলী। তাঁর ভাষায়,
“চরের পলি পড়া জমিতে পেঁয়াজ-রসুনের ফলন খুব ভালো হয়। নিজেদের খরচের পাশাপাশি বিক্রিও করা যায়।”
তবে যোগাযোগব্যবস্থা দুর্বল হওয়ায় উৎপাদিত পণ্য পরিবহনে কষ্ট হয়। শেষের দিকে নদীতে পানি কমে গেলে সেচ সংকটও দেখা দেয়।
কৃষকের পাশে প্রশাসন
লক্ষ্মীটারী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল হাদী বলেন,
বর্ষায় তিস্তার খরস্রোতে চর ডুবে যায়, ফসল নষ্ট হয়, জমি-ঘরবাড়ি ভাঙনে বিলীন হয়। কিন্তু শুষ্ক মৌসুমে এই চরই কৃষকের আশীর্বাদ। আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি, বীজ, সার ও সেচ সুবিধা পেলে উৎপাদন আরও বাড়বে।
গঙ্গাচড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সৈয়দ শাহিনুর ইসলাম জানান, এ বছর ১৬০ হেক্টর জমিতে কুমড়া চাষের লক্ষ্য ছিল; ইতোমধ্যে ১০০ হেক্টরে চাষ সম্পন্ন হয়েছে। কৃষকদের নিয়মিত পরামর্শ ও সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।
রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক সিরাজুল ইসলাম বলেন, তিস্তায় বিশাল চরের আবাদ স্থানীয় অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখছে। উৎপাদিত মিষ্টিকুমড়া বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। সেচ সুবিধা নিশ্চিত করতে বিএডিসি বারিড পাইপ স্থাপন করেছে, বাকি জায়গা কৃষকেরা নিজ উদ্যোগে সামাল দিচ্ছেন।
সিএ/এএ


