আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে জনগণের ভোটে সরকার গঠন করতে পারলে দেশের অর্থনীতি, শিক্ষা, কৃষি, কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্য, পরিবেশ ও ক্রীড়াসহ বিভিন্ন খাত পুনর্গঠনে বিএনপি আটটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ঢাকার ফার্মগেটে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে বিএনপি আয়োজিত ‘দেশ গড়ার পরিকল্পনা’ শীর্ষক সপ্তাহব্যাপী ধারাবাহিক অনুষ্ঠানে শনিবার (৬ ডিসেম্বর) দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এই পরিকল্পনাগুলো উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, ক্ষমতায় গেলে বিএনপি দেশের প্রতিটি সেক্টরকে আধুনিক, স্বচ্ছ ও জনবান্ধব কাঠামোয় রূপান্তর করবে।
প্রথম পরিকল্পনা হিসেবে তারেক রহমান তুলে ধরেন কৃষকের জন্য নিরাপদ ও নির্ভরযোগ্য কৃষক কার্ড ব্যবস্থার কথা। কৃষক কার্ডের মাধ্যমে কৃষকের হাতেই দ্রুত সেবা পৌঁছানো, ন্যায্য দামে সার, বীজ, কীটনাশক, সরকারি ভর্তুকি, সেচ সুবিধা, কৃষিযন্ত্র ভাড়ায় প্রাপ্তি, সহজ শর্তে কৃষি ঋণ, কৃষি বীমা, পণ্যের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করা হবে। কৃষিবিষয়ক প্রশিক্ষণ, আবহাওয়া ও বাজারের তথ্য, মোবাইলে সহজে ফসলের রোগ নির্ণয়, মৎস্যচাষি ও খামারিদের জন্য একই সুবিধা নিশ্চিত করার পরিকল্পনাও তুলে ধরা হয়।
দ্বিতীয় পরিকল্পনায় গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে দেশব্যাপী কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য স্বল্প সুদে ঋণ, অ্যামাজন-আলিবাবাসহ বৈশ্বিক ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মে রপ্তানি সহায়তা, ব্যাংকিং খাত স্বচ্ছ করা, সরকারি চাকরিতে মেধাভিত্তিক নিয়োগ নিশ্চিত করা, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি ও উন্নয়ন প্রকল্পে চাকরির সুযোগ বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। তথ্যপ্রযুক্তি–ভিত্তিক নতুন শিল্প যেমন সাইবার নিরাপত্তা, আউটসোর্সিং, সেমিকন্ডাক্টর, ইন্টিলিজেন্স টেকনোলজির মাধ্যমে ৮ লাখ নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্য ঘোষণা করা হয়।
কর্মসংস্থানে সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক পেমেন্ট সুবিধা চালু, ফ্রিল্যান্সারদের জন্য পেপালসহ বৈশ্বিক পেমেন্ট গেটওয়ে সক্রিয় করা, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নারী, গৃহিণী, প্রবীণ ও দীর্ঘমেয়াদি বেকারদের জন্য বিশেষ কর্মসূচি চালু এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক সেক্টরের শ্রমিকদের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতের পরিকল্পনা তুলে ধরা হয়। সরকারি প্রতিষ্ঠান, রেলস্টেশন, হাসপাতাল, বিমানবন্দরসহ জনবহুল স্থানে বিনামূল্যে ইন্টারনেট সুবিধা, বিদেশে কর্মসংস্থানের জন্য ভাষা–দক্ষতা প্রশিক্ষণ এবং কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যারিয়ার সেন্টার স্থাপনের প্রতিশ্রুতিও এই পরিকল্পনার অংশ।
তৃতীয় পরিকল্পনায় ঘোষণা করা হয় ফ্যামিলি কার্ড। দেশের প্রতিটি পরিবারকে পর্যায়ক্রমে ফ্যামিলি কার্ড প্রদান করে মাসে ২০০০–২৫০০ টাকা আর্থিক সহায়তা অথবা চাল, ডাল, তেল, লবণসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী দেওয়ার পরিকল্পনা তুলে ধরেন তারেক রহমান। তিনি জানান, এই কার্ডের মাধ্যমে নারীর স্বাবলম্বিতা, দারিদ্র্য বিমোচন ও পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে।
চতুর্থ পরিকল্পনায় শিক্ষা খাতের আধুনিকায়ন, দক্ষ জনশক্তি তৈরির লক্ষ্য এবং নতুন বাংলাদেশ গড়ার সম্ভাবনা উল্লেখ করেন তিনি। ওয়ান টিচার, ওয়ান ট্যাব প্রকল্পের আওতায় সব শিক্ষককে আধুনিক প্রশিক্ষণসহ ট্যাবলেট প্রদান, শিক্ষাকে আনন্দময় করার লক্ষ্যে ‘লার্নিং উইথ হ্যাপিনেস’ উদ্যোগ, কারিগরি শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা, স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ, মিড-ডে মিল, মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম, তৃতীয় ভাষা শিক্ষা এবং ক্রীড়া ও সংস্কৃতিকে পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনা বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়। মেধাবী শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি এবং টেকনিক্যাল শিক্ষাকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার কথাও বলা হয়।
পঞ্চম পরিকল্পনায় ঘোষণা করা হয় দুর্নীতিমুক্ত স্বাস্থ্যসেবার রূপরেখা। দেশের প্রতিটি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা, এক লাখ নতুন স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ (যার ৮০ শতাংশ নারী), মহানগর ও জেলা শহরে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা, গ্রাম পর্যায়ে রোগ প্রতিরোধ এবং মাতৃ–শিশু স্বাস্থ্যসেবা জোরদার করা, প্রাণঘাতী রোগে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের আওতায় সাশ্রয়ী চিকিৎসা নিশ্চিত করা এবং দেশের সব অঞ্চলে ওষুধ ও ভ্যাকসিন সরবরাহ ব্যবস্থা শক্তিশালী করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, চিকুনগুনিয়াসহ মশাবাহিত রোগ নির্মূলে বৈজ্ঞানিক পরিকল্পনার কথাও উল্লেখ করেন তিনি।
ষষ্ঠ পরিকল্পনায় ধর্মীয় নেতাদের সামাজিক–অর্থনৈতিক উন্নয়নকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। খতিব, ইমাম-মুয়াজ্জিনদের মাসিক সম্মানী, উৎসবভাতা, দক্ষতা প্রশিক্ষণ, মসজিদভিত্তিক শিশু শিক্ষা সম্প্রসারণ, ইমাম কল্যাণ ট্রাস্টকে শক্তিশালী করা এবং হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানসহ অন্যান্য ধর্মীয় নেতাদের একই সুবিধা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি ঘোষিত হয়।
সপ্তম পরিকল্পনা হিসেবে পরিবেশ, নদী–খাল–বিল রক্ষা ও পানিপ্রবাহ পুনরুদ্ধারের কর্মপরিকল্পনা তুলে ধরা হয়। সারা দেশে ২০ হাজার কিলোমিটার খাল–নদী খনন ও পুনঃখনন, তিস্তা ব্যারেজ উন্নয়ন, পদ্মা ব্যারেজ নির্মাণ, পাঁচ বছরে ২৫ কোটি গাছ রোপণ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা আধুনিকায়ন এবং জৈব সার, জ্বালানি উৎপাদনের মাধ্যমে পরিবেশকে দূষণমুক্ত করার লক্ষ্য ঘোষণা করা হয়।
অষ্টম পরিকল্পনায় দেশের ক্রীড়া উন্নয়নকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়। খেলাধুলাকে পেশা হিসেবে প্রতিষ্ঠা, চতুর্থ শ্রেণি থেকে বাধ্যতামূলক ক্রীড়া শিক্ষা, ‘নতুন কুঁড়ি স্পোর্টস’ বৃত্তি, ৬৪ জেলায় ইনডোর স্পোর্টস ভিলেজ, প্রতিটি উপজেলায় ক্রীড়া অফিসার ও শিক্ষক নিয়োগ, প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ক্রীড়া শিক্ষক, বিভাগীয় শহরে বিকেএসপির শাখা, গ্রাম পর্যায়ে খেলার মাঠ পুনর্গঠন, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের ক্রীড়া সুযোগ এবং স্থানীয় ক্রীড়া সরঞ্জাম শিল্প গড়ে তোলার পরিকল্পনা উপস্থাপন করা হয়।
সিএ/ইরি


