ভারত–যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য চুক্তি: অগ্রগতি হলেও জট কাটেনি
৯ জুলাইয়ের আগেই ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একটি অন্তর্বর্তী বাণিজ্য চুক্তির চেষ্টা চলছে। তবে আলোচনা এখন কঠিন দর-কষাকষির মধ্যে রয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের দেওয়া সময়সীমা সামনে রেখেই হোয়াইট হাউস থেকে বলা হয়েছে, চুক্তি হতে চলেছে। ভারতের অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণও জানিয়েছেন, বড় পরিসরের চুক্তিকে ভারত স্বাগত জানাবে।
তবে বাস্তবে, দুই দেশের মধ্যে এখনও কয়েকটি মূল ইস্যুতে মতপার্থক্য কাটেনি—বিশেষ করে কৃষিপণ্য, গাড়ির যন্ত্রাংশ ও ইস্পাতের ওপর শুল্ক নিয়ে। যুক্তরাষ্ট্র চাইছে, ভারত তার কৃষিপণ্যের বাজার আরও উন্মুক্ত করুক, কিন্তু ভারত বলছে, কৃষি ও দুগ্ধ খাত জাতীয় অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং সেখানে ছাড় দেওয়া সম্ভব নয়।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ট্রেড রিসার্চ ইনিশিয়েটিভের প্রধান অজয় শ্রীবাস্তবের মতে, আগামী এক সপ্তাহের মধ্যেই বোঝা যাবে আলোচনার পরিণতি—চুক্তি হবে নাকি তা স্থগিত থাকবে। আর সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিসের বিশ্লেষক রিচার্ড রসোর মন্তব্য, যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিপণ্য রপ্তানির ইচ্ছার মুখে ভারত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতায় কৃষি খাতে সুরক্ষা দিতে বাধ্য।
কৃষির পাশাপাশি আরেকটি বড় ইস্যু হলো ভারতের অশুল্ক বাধা, যেমন মান নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত ‘কোয়ালিটি কন্ট্রোল অর্ডার’। যুক্তরাষ্ট্রের মতে, এসব নিয়ম পণ্যের আমদানিতে বাধা তৈরি করছে। ভারতের যুক্তি, নিম্নমানের পণ্য ঠেকাতে এবং স্থানীয় উৎপাদকদের সুরক্ষা দিতেই এসব নিয়ম চালু হয়েছে। যদিও নীতি আয়োগের এক সদস্য এটিকে ছোট ব্যবসার ব্যয় বাড়ানোর মতো “বিপজ্জনক হস্তক্ষেপ” বলেও উল্লেখ করেছেন।
বর্তমানে ভারত–মার্কিন কৃষিপণ্য বাণিজ্যের পরিমাণ মাত্র ৮০০ কোটি ডলার। ভারত থেকে চাল, চিংড়ি ও মসলা রপ্তানি হয়; আর আমদানি হয় বাদাম, আপেল ও ডাল। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসন চাইছে, ভারত বিপুল পরিমাণে ভুট্টা, সয়াবিন, তুলা ইত্যাদি আমদানি করুক—যাতে ৪৫ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য ঘাটতি কিছুটা কমে। তবে এতে ভারতের কৃষকদের জন্য নির্ধারিত ন্যূনতম সহায়ক মূল্য ও সরকারি ক্রয়ব্যবস্থা হুমকির মুখে পড়তে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, চাল, গম ও দুগ্ধজাত পণ্যে শুল্ক ছাড় পাওয়ার সম্ভাবনা প্রায় নেই। অথচ নীতি আয়োগের এক খসড়া প্রতিবেদনে মার্কিন চাল, দুধ, কর্ন, জিএম সয়াবিন প্রভৃতি পণ্যে শুল্ক কমানোর সুপারিশ করা হয়েছে, যদিও তা এখনো বাস্তবায়িত হয়নি।
রসো বলেন, যদি যুক্তরাষ্ট্র কৃষিপণ্যে ছাড় না পেলে চুক্তি করবে না বলে জানায়, তাহলে সেটি ভুল প্রত্যাশা। কারণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বাণিজ্যনীতির একটি রাজনৈতিক সীমা থাকেই।
বিশেষজ্ঞদের ধারণা, বড় পরিসরের বদলে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মধ্যে হওয়া সীমিত পরিসরের চুক্তির মতো ছোট পরিসরের একটি চুক্তিই হতে পারে। এতে ভারত কিছু নির্দিষ্ট শিল্পপণ্যে শুল্ক কমাতে পারে, আবার বাদাম, আপেল, জলপাই তেল ইত্যাদি কৃষিপণ্যে সীমিত ছাড় দিতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্র চায়, ভারত মার্কিন তেল, গ্যাস, বিমান, হেলিকপ্টার ও পরমাণু প্রযুক্তি কিনুক এবং খুচরা বাজারে বিদেশি বিনিয়োগের সুযোগ আরও বাড়াক। তবে এসব নিয়ে আপাতত কৌশলগত প্রতিশ্রুতি পর্যন্তই আলোচনা সীমিত থাকবে। ডিজিটাল নীতি, মেধাস্বত্ব বা পরিষেবা খাত সংক্রান্ত বিষয়গুলো পরবর্তী পর্যায়ে আলোচনায় আসবে।
প্রথমদিকে দুই দেশের মধ্যে যে সমীকরণ ছিল—যুক্তরাষ্ট্র পুঁজিনির্ভর পণ্য দেবে, আর ভারত শ্রমনির্ভর পণ্য—এখন সেই ধারণাও কিছুটা বদলেছে।
যদি আলোচনায় চূড়ান্ত চুক্তি না হয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের ওপর আবার ২৬% হারে বাড়তি শুল্ক আরোপ করবে না বলেই আশা করা হচ্ছে। বরং, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ন্যূনতম নীতির ভিত্তিতে বেশির ভাগ পণ্যের ওপর ১০% হারে সাধারণ শুল্ক বসতে পারে, যেমনটা যুক্তরাজ্য বাদে ৫৭টি দেশের ক্ষেত্রে ইতিমধ্যে করা হয়েছে।
তবে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলছেন—ট্রাম্প যেকোনো সময় চমক দিতে পারেন।