মডেলটির বিস্তারিত আলোচনা করার আগে কিছু সিচুয়েশন বলি এবং কিছু প্রশ্ন করি।
→আমাদের দেশে যেমন অনেক বেকার আছে তেমনি অনেক কর্মক্ষেত্রও আছে; ব্যপারটা এমন না যে সব জায়গায় দক্ষ লোক থাকার পরে কিছু লোক অতিরিক্ত আছে যারা চাকরী পাচ্ছে না, এমনটা হলে মানা যেত, কিন্তু বাস্তবতা বলছে দেশে বেকার যেমন আছে তেমনি অনেক কর্মক্ষেত্রও এখনো ফাঁকা পরে আছে যেখানে তারা দক্ষ মানবসম্পদ পাচ্ছে না।
কিন্তু কেন এমন হচ্ছে?
→প্রায়ই শোনা যায় অনেকেই বলেন, “এত ডিগ্রী নিলাম, এতকিছু জানি তবুও কেউ চাকরী দিচ্ছে না”। একইভাবে অনেক প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরাও বলেন, “পদ খালি পরে আছে অথচ দক্ষ লোক পাচ্ছি না”।
তার মানে দক্ষ এবং আগ্রহী কর্মী যেমন আছে তেমনি দক্ষতার মূল্যায়ন করার মত নিয়োগদাতা বা প্রতিষ্ঠানও আছে। কিন্তু তারপরও উভয় পক্ষই যার যার জায়গা থেকে হতাশ! উভয়েই নিজ নিজ অবস্থানে ঠিক থেকেও চাহিদানুযায়ী কিছু পাচ্ছে না এবং দুই পক্ষের সম্মিলনটাও ঘটছে না- যার ফলে উভয় পক্ষের সাথে সাথে আমাদের দেশ ও অর্থনীতিও বঞ্চিত হচ্ছে।
কিন্তু কেন এমন হচ্ছে? গ্যাপটা কোথায়? কি তার সমাধান?
→প্রায় চাকরীতেই বলা হয় “এত বছরের অভিজ্ঞতা প্রয়োজন”, খুব সীমিত কিছু ক্ষেত্র, পদ বা প্রতিষ্ঠান ছাড়া অনভিজ্ঞ বা ফ্রেশারসদের জন্য সুযোগটাও থাকে অনেক কম; কিন্তু নতুনদের অভিজ্ঞতা হওয়ার জন্যেও তো কাজ করা লাগবে, সেই কাজের সুযোগটা আগে না দিলে তারা অভিজ্ঞতা পাবে কিভাবে?
সবাই যদি শুরুতেই দক্ষ ও অভিজ্ঞ মানবসম্পদ চায় তাহলে তাদেরকে অভিজ্ঞ বানানোর দায়িত্বটা কে নিবে? এতে করে কি সামাজিক দায়বদ্ধতা এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে না?
বলা যেতেই পারে, “পড়াশুনা করেই তো সব শেখার কথা” অথবা “অমুক তমুক কোর্স-ট্রেইনিং করলেই তো চাকরীর ক্ষেত্রে কাজে লাগে”।
কিন্তু কথা হচ্ছে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাটি এমন, এখানে যা শেখানো হয় বা আমরা শিখি সেটা চাকরীক্ষেত্রে কতটুকুই বা কার্যকর?
আমরা চাকরীতে প্রবেশের ক্ষেত্রে দেখি সেখানে প্রায়(!) সবাই সব চাকরী করে, বিশেষায়িত সাবজেক্ট বা কোর্স রিলেটেড চাকরী খুব কমই হয়, আবার সারাবছর হয়তো পড়াশুনা করি একভাবে কিন্তু চাকরীর পরীক্ষায় উত্তর করা লাগে অন্য জিনিস, যেখানে ওই চার-পাঁচ বছরের ডিগ্রীর ছিঁটেফোটাও প্রকাশ করা লাগে না।
ডিগ্রীর পর ডিগ্রী বাড়ছে, কোর্সের পর কোর্স- কিন্তু সেসব কর্মক্ষেত্রে কাজে লাগছে কতটুকু? বা যতটুকু কাজে লাগে তার কতটুকুই বা আমরা দক্ষতার সাথে কাজে লাগাতে পারি? আবার একাডেমিক পড়াশুনা বা শর্ট কোর্স যতই করা হোক একটা “রিয়েল অর্গানাইজেশনে” কাজের মাধ্যমে যে শেখা সেটা কিন্তু হয়না। তার মানে সেই গ্যাপটা থেকেই যাচ্ছে।
দেখা গেল আমি চাকরী করব ব্যাংকে যেখানে আমাকে আর্থিক হিসেব করতে হবে সফটওয়্যারের মাধ্যমে আর অন্যসব কাজ নেতৃত্বের গুণাবলি, ব্যবস্থাপনার দক্ষতা ও আন্তঃব্যক্তিত সম্পর্ক ও যোগাযোগের যাদুর সাহায্যে- কিন্তু আমার চাকরীর পরীক্ষায় যাচাই করা হচ্ছে কয়টা অংক বা শব্দের অর্থ জানি, কয়টা সাধারন জ্ঞান জানি সেসব।
আর সরকারী চাকরীর পরীক্ষার কথা নাই বলি, সেখানে তো সর্বরোগের এক ঔষধের মত অবস্থা, সবকিছুর জন্য একই জিনিস যাচাই করা হচ্ছে।
ছোট্ট একটি উদাহরন দেই-
ধরুন একটি ব্যাংকে মার্কেটিংয়ের জন্য লোক নিবে, সেই সাথে আভ্যন্তরিন কাজের জন্যেও লোক লাগবে কয়েকজন। স্বাভাবিকভাবেই অংক, ইংরেজী, সাধারন জ্ঞানের পরীক্ষা নিয়ে প্রার্থীদের যাচাই করা হল।
পরীক্ষায় এমন একজন বাদ পড়লো যার কাস্টমারকে কনভিন্স করার দক্ষতা অসাধারন, আরেকজনেরও মার্কেটিংয়ের ম্যাজিক দারুন। কিন্তু তারা দুজনই পরীক্ষার প্রশ্নগুলো কম পেরেছে অথবা ওই প্রশ্নগুলোই তাদের কমন পড়েনি। তাই তারা বাদ পড়ে গেল।
অপরদিকে এমন একজন পরীক্ষায় ভাল করল যে ওই প্রশ্নগুলোর সব জানে অথচ কাস্টমারের সাথে কথা বলতেও পারবে না। কিন্তু যেহেতু পরীক্ষায় ভালো করেছে সে নিয়োগ পেয়ে গেল।
এই পুরো প্রক্রিয়াটাতে দুটো যোগ্য প্রার্থী কি বাদ পড়ে গেলো না? একইভাবে অযোগ্যদের নিয়ে প্রতিষ্ঠান কি ক্ষতিগ্রস্থ হল না? এরাও হয়তো যোগ্য হবে, কিন্তু এদের যোগ্য করার পিছনেও কিন্তু প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ ভালোই হবে। ফলে প্রতিষ্ঠানের খরচের পরিমাণও বাড়ছে।
তার মানে এসবের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যেমন ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে তেমনি দেশের উদীয়মাণ মানবসম্পদগুলোও বঞ্চিত ও অবহেলিত হচ্ছে।
তাহলে এসবের সমাধান কি?
উপায় কি এই অবস্থা থেকে উত্তরণের, যা থেকে সবাই লাভবান হবে?
♠আমার মডেল ও প্রস্তাবনা♠
প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের একটি “Student Engagement and Grooming” বা “SEG” ডিভিশন থাকবে। এই ডিভিশনের কাজ হবে-
→বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে নিজেদের প্রতিষ্ঠানের ধরন, কর্মক্ষেত্র এবং শিক্ষার্থীর আগ্রহ ও দক্ষতার ভিত্তিতে তাদের মধ্য থেকে যতজনকে সম্ভব নিজেদের সাথে জড়িত করা।
→প্রতিষ্ঠানের ছোট ছোট কাজগুলো একসাথে করে যেসব কাজে রিস্ক কম, অনেক দক্ষতার দরকার নেই বা চাইলেই রেগুলার স্টাফ ছাড়াও যে কাউকে দিয়েই করানো যায়; সেই কাজগুলো এসব ছাত্রছাত্রীদেরকে দেয়া এবং তাদেরকে যৌক্তিক ও যথার্থ সম্মানী দেয়া।
→শিক্ষার্থীদের সুবিধামত সময়ে কাজের সুযোগ দেয়া যেন তারা বন্ধের দিন বা ক্লাস শেষে বিকেলে কাজ করতে পারে।
→যেসব কাজ সরাসরি না এসেও নিজের বাসা/হলে থেকে করা যায় সেগুলো সেভাবেই প্যাকেজ হিসেবে করতে দেয়া, যেন তারা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে যখন যেখানে ইচ্ছা কাজটি করে দিলেই চলবে, এমন।
→পুরো প্রোগ্রামটিকে বিচ্ছিন্ন কাজ হিসেবে না রেখে যারা কাজ করবে তাদেরকে নিয়মিত সুযোগ দেয়া সবং এই প্রতিষ্ঠানেরই ভিন্ন ধারার কর্মী হিসেবে বিবেচনা করে তারা যতদিন কাজ করবে তার সার্টিফিকেট দেয়া যেন সেটা অভিজ্ঞতা হিসেবে সব জায়গায় গৃহীত হয়।
→শিক্ষার্থীদেরকে নিয়মিত ক্যারিয়ার গাইডলাইন ও প্রয়োজনীয় ট্রেইনিং দেয়া এবং কেউ উদ্যোক্তা হতে চাইলে তাদেরকে তার জন্য গাইডলাইন ও সহায়তা করা।
এতে করে সবগুলো সমস্যার অনেকটাই সমাধান চলে আসবে। কীভাবে?!
→যেহেতু শিক্ষার্থীরা দীর্ঘ সময় প্রতিষ্ঠানের সাথে থাকবে, সেহেতু উভয়পক্ষেরই একটা যোগাযোগ থাকবে; তাই পাশ করলে শিক্ষার্থীরাও সহজে চাকরী পাবে, একইভাবে নিয়োগদাতারাও অনেক শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে দক্ষ কাউকে বেছে নিতে পারবে।
→নিয়োগদাতারা যেমন অভিজ্ঞতা খুঁজেন, উনারা নিজেদের হাতে তৈরী করা দক্ষ ও অভিজ্ঞ মানবসম্পদ থেকেই বাছাই করে নিতে পারবে; একইভাবে সদ্য পাশ করা শিক্ষার্থীরাও অভিজ্ঞতার অভাবে চাকরী থেকে বঞ্চিত হবে না, তারা পাশ করার সাথে সাথেই বেশ কয়েক বছরের অভিজ্ঞতারও মালিক হয়ে যাবে, With Certificate.
-যেহেতু প্রতিষ্ঠানের সাথে কাজ করে, প্রতিষ্ঠানের হাতেই তারা তৈরী হবে সেহেতু যে যেই কাজে দক্ষ তাকে সেই কাজে অর্থাৎ Right Person for Right Position এটা সম্ভব হবে; তখন আর শুধুমাত্র ইংরেজী শব্দের অর্থ আর সুদাসলের অংক না জানার কারনে চৌকষ মার্কেটিংকর্মী বাদ পড়ে যাওয়ার যে ঘটনা সেটি ঘটবে না। ফলে প্রতিষ্ঠান যেমন বেস্ট আউটপুট পাবে তেমনি কর্মীও বঞ্চিত হবে না; একইসাথে প্রতিষ্ঠানের “মানবসম্পদ তৈরী করার অতিরিক্ত খরচ” অনেকটাই কমবে।
এবার আসি মডেলটিকে “Reciprocal Boon” অর্থাৎ “পারস্পরিক লাভজনক” নাম কেন দিয়েছি। মূলত এই মডেলটির মাধ্যমে একপক্ষ উপকৃত হবে না; সকল পক্ষই উপকৃত হবে সর্বোপরি আমাদের সমাজ ও অর্থনীতির উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে।
Benefits of HR-
→পাশ করে কেউ বেকার থাকবে না। পাশ করার আগেই একটা চাকরী পাওয়ার ব্যপারে নিশ্চিত থাকতে পারবে।
→অভিজ্ঞতার অভাবে চাকরী না পাওয়ার যে আক্ষেপ সেটা কমে যাবে।
→শিক্ষার্থীরা তাদের ক্লাস-পরীক্ষার ফাঁকে সুবিধামত সময়ে কাজ করতে পারবে।
→নিজের পছন্দের ও আগ্রহের জায়গাটিতেই কাজ করার সুযোগ পাবে, ফলে আত্মতৃপ্তি থাকবে মনে।
→চাকরীতে আসার আগেই প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ ও কর্মক্ষেত্র সম্পর্কে পূর্ণ ধারণা ও দক্ষতা হবে।
→প্রতিষ্ঠানের সাথে নিজেকে খাপ খাওয়াতে সুবিধা হবে।
→ছাত্রজীবন থেকেই রোজগার করতে পারবে সেই সাথে দক্ষতাও হবে, ফলে আর্থিক টানাপোড়েন থাকলেও তা কমে যাবে।
→টিউশনি বা অন্য কোন কাজ করলে এদিকে নিজেকে প্রস্তুত করার মত সময় পাওয়া কষ্টকর, আবার সব ছেড়ে শুধু ট্রেইনিং বা কোর্স করলে আয় রোজগার হয়না, উলটো টাকা লাগে- এই সমস্যাটা থাকবে না।
→কেউ চাইলে এই টাকা জমিয়ে এবং অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে উদ্যোক্তাও হতে পারবে।
Benefits for Organization-
→দক্ষ মানবসম্পদ সহজেই খুঁজে পাবে।
→সঠিক জায়গায় সঠিক মানুষকে নিয়োগ দিতে পারার ফলে উৎপাদনশীলতা বাড়বে।
→নিয়োগ দেয়ার সময়, ঝাঁমেলা, খরচ সবকিছুই কমে যাবে।
→নিয়োগ দেয়ার পরে তাদেরকে তৈরী করতে যে সময় ও অর্থ ব্যয় হয় তা অনেকটাই কমে যাবে।
→পার্মানেন্ট কর্মীদের বাইরে শিক্ষার্থীদের দিয়ে কাজ করানোর ফলে অফিস টাইমের পর বা বন্ধের দিনেও কাজ চালানো যাবে যার ফলে অতিরিক্ত কাজ হবে সেই সাথে নিয়মিত কর্মীদের ওভারটাইম করার চাপ কমে যাবে ফলে তারাও সন্তুষ্ট থাকবে।
→যেহেতু নিয়মিত কর্মীর সংখ্যা নির্ধারিত কিন্তু শিক্ষার্থীরা অসংখ্য তাই অতিরিক্ত কাজের চাহিদা অনুযায়ী তাদের মধ্য থেকে অতিরিক্ত Manpower Support নেয়া যাবে।
Benefits of Society-
→বেকারত্বের হার কমবে।
→অধিক দক্ষ মানবসম্পদ তৈরী হবে।
→মানবসম্পদের পূর্ণ ও যথাযথ ব্যবহার করা হবে।
→উৎপাদনশীলতা বাড়বে।
→নতুন নতুন উদ্যোক্তা তৈরী হবে।
→দেশের আর্থিক কাঠামো মজবুত হবে।
সামগ্রীকভাবে বলতে গেলে মোটামুটি সকল পক্ষের জন্যই মডেলটি লাভজনক সেই সাথে দেশের ও অর্থনীতির জন্যেও ভালো কিছু সম্ভব এর দ্বারা।
মডেলটি যদি যথাযথভাবে কাজে লাগানো যায় তাহলে এর মাধ্যমে আমাদের তরুন সমাজ, শিক্ষার্থী, প্রতিষ্ঠান ও দেশের জন্য খুব দারুন কিছু হবে বলে আমার বিশ্বাস।
লেখকঃ Md. Nazmul Hossain
BBA (Managment)
MBA (HRM)
Jahangirnagar University